বাংলাদেশের রাজনীতিতে টাকা বরাবরই একটি অস্বস্তিকর অথচ নির্ধারক বাস্তবতা। নির্বাচন এলেই আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে কালো টাকা, পেশিশক্তি, অঘোষিত ব্যয় আর ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেই খরচ উঠিয়ে নেওয়ার অদৃশ্য প্রতিযোগিতা। এই দীর্ঘদিনের চর্চার ভেতর হঠাৎ করে এক ভিন্ন দৃশ্য সামনে এসেছে, যা অনেকের চোখে আশার আলো, আবার কারও কাছে কৌতূহল ও সন্দেহের নতুন বিষয়। ঢাকা–৯ আসনের সংসদ সদস্য প্রার্থী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারার আহ্বানে সাধারণ মানুষের ছোট ছোট অনুদানে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই লাখ টাকার বেশি অর্থ জমা পড়ার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক ব্যতিক্রমী মুহূর্ত তৈরি করেছে।
ফেসবুকে দেওয়া একটি ভিডিও ও পরবর্তী স্ট্যাটাস থেকেই শুরু হয় এই ঘটনা। রাতের নিস্তব্ধতায় দেওয়া সেই আহ্বানে তাসনিম জারা সরাসরি বলেন, তিনি কালো টাকার রাজনীতি করতে চান না, আইনের বাইরে এক টাকাও খরচ করবেন না এবং সেই কারণেই তিনি সাধারণ মানুষের কাছে নির্বাচনী ব্যয়ের অর্থ চাইছেন। এই বক্তব্য নতুন নয়, অনেকেই আগে এমন কথা বলেছেন। কিন্তু নতুন ছিল এর বাস্তব প্রয়োগের দৃশ্যমানতা। নিজের বিকাশ নম্বর ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট প্রকাশ করে তিনি যে ঝুঁকি নিলেন, তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল। আর সেই ঝুঁকির জবাবও এলো দ্রুত—মাত্র চার ঘণ্টায় পাঁচ লাখ টাকার বেশি, সাত ঘণ্টায় বারো লাখ টাকারও বেশি অনুদান।
এই অর্থের অঙ্ক যতটা আলোচনার জন্ম দিয়েছে, তার চেয়েও বেশি আলোড়ন তুলেছে অর্থের প্রকৃতি। তাসনিম জারার ভাষায়, অধিকাংশ অনুদান এসেছে ৫ টাকা, ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকা বা ১০০ টাকার মতো ক্ষুদ্র অঙ্কে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছোট ছোট বার্তা—‘আমি স্টুডেন্ট, সামর্থ্য অনুযায়ী দিলাম’, ‘আপু, সৎ রাজনীতির জন্য এইটুকু’, ‘আমাদের মতো সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন’। এই বার্তাগুলো যেন কেবল অর্থ পাঠানোর তথ্য নয়, বরং দীর্ঘদিনের জমে থাকা এক ধরনের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। যে আকাঙ্ক্ষা রাজনীতিকে আবার নিজের বলে ভাবতে চায়, সিন্ডিকেট আর কোটি টাকার খেলার বাইরে এনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে ফিরিয়ে নিতে চায়।
বাংলাদেশের নির্বাচনী বাস্তবতায় এই ঘটনা কেন এত আলোচিত, তা বোঝার জন্য একটু পেছনে তাকানো জরুরি। নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী একজন সংসদ সদস্য প্রার্থী সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা বা ভোটারপ্রতি ১০ টাকা খরচ করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ আসনেই এই অঙ্ক বহু গুণ ছাড়িয়ে যায়। পোস্টার, ব্যানার, কর্মী, যানবাহন, কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা—সব মিলিয়ে খরচ পৌঁছে যায় কোটি টাকায়। এই বিপুল অর্থের উৎস কোথায়, তা প্রকাশ্যে কেউ বলে না। ফলে নির্বাচনে জেতার পর সেই টাকা তুলতে গিয়ে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহার প্রায় ‘স্বাভাবিক’ প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়। তাসনিম জারা এই বাস্তবতাকেই সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছেন।
তার স্ট্যাটাসে বলা কথাগুলো আসলে একটি নৈতিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়—যদি রাজনীতিতে প্রবেশের শুরুটাই হয় আইন ভাঙা আর মিথ্যা বলার মাধ্যমে, তাহলে সেখান থেকে সৎ শাসনের প্রত্যাশা কতটা যৌক্তিক? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতেই তিনি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের পথ বেছে নিয়েছেন বলে ব্যাখ্যা করেন। তিনি জানান, ঢাকা–৯ আসনে আইন অনুযায়ী তিনি সর্বোচ্চ ৪৬ লাখ ৯৩ হাজার ৫৮০ টাকা খরচ করতে পারবেন, এবং এই পুরো অর্থই তিনি জনগণের কাছ থেকে নিতে চান। লক্ষ্য পূরণ হলেই ফান্ডরেইজিং বন্ধ করবেন, প্রতিটি টাকার হিসাব প্রকাশ করবেন—এই প্রতিশ্রুতিও তিনি দিয়েছেন।
এই উদ্যোগকে অনেকেই দেখছেন ‘ক্রাউডফান্ডেড পলিটিক্স’-এর একটি প্রাথমিক রূপ হিসেবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে, সাধারণ মানুষের ছোট অনুদানে রাজনৈতিক প্রচারণা চালানো নতুন কিছু নয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে রাজনীতির সঙ্গে টাকার সম্পর্ক প্রায় অচ্ছেদ্য বলে বিবেচিত, সেখানে এমন উদ্যোগ স্বাভাবিকভাবেই আলোচনার জন্ম দেয়। সামাজিক মাধ্যমে কেউ একে ‘নতুন রাজনীতির সূচনা’ বলছেন, কেউ আবার প্রশ্ন তুলছেন—এই অর্থ সংগ্রহ কতটা টেকসই, ভবিষ্যতে কি এটি বড় পরিসরে সম্ভব হবে?
সমালোচনাও একেবারে অনুপস্থিত নয়। কেউ কেউ বলছেন, সামাজিক মাধ্যমে জনপ্রিয়তা থাকায় তাসনিম জারার পক্ষে এই অর্থ সংগ্রহ সহজ হয়েছে, কিন্তু মাঠপর্যায়ের রাজনীতিতে এর বাস্তব প্রভাব কতটা হবে, তা অনিশ্চিত। আবার কেউ প্রশ্ন তুলছেন স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি বাস্তবে কতটা রক্ষা করা যাবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবতার ব্যবধান নিয়ে মানুষের সন্দেহ স্বাভাবিক। তবু এই সন্দেহের মাঝেও যে বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না, তা হলো মানুষের সাড়া। এত অল্প সময়ের মধ্যে এত মানুষের অংশগ্রহণ দেখিয়ে দিয়েছে, রাজনীতির প্রতি অনাস্থার আড়ালেও এক ধরনের গভীর আগ্রহ ও প্রত্যাশা এখনো রয়ে গেছে।
এই ঘটনাটি আরও একটি বড় সামাজিক বাস্তবতাও সামনে এনেছে। সাধারণ মানুষ রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছে—এমন অভিযোগ বহুদিনের। কিন্তু তাসনিম জারার আহ্বানে যেভাবে মানুষ পাঁচ বা দশ টাকা পাঠিয়েছে, তাতে বোঝা যায়, মানুষ রাজনীতি থেকে দূরে নয়; বরং তারা এমন একটি রাজনীতির অপেক্ষায় আছে, যেখানে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে, যেখানে তাদের দেওয়া ছোট অঙ্কের টাকাও মূল্য পাবে। এই অংশগ্রহণ কেবল আর্থিক নয়, এটি মানসিক ও নৈতিক সমর্থনের প্রকাশও।
ঢাকা–৯ আসনের প্রেক্ষাপটও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। রাজধানীর একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন হিসেবে এটি রাজনৈতিকভাবে সবসময়ই নজরকাড়া। এই আসনে লড়াই মানেই শুধু ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা নয়, বরং রাজনৈতিক বার্তার লড়াইও। তাসনিম জারার উদ্যোগ সেই বার্তাকেই সামনে এনেছে—রাজনীতি মানেই কোটি টাকার খেলা নয়, চাইলে অন্য পথেও হাঁটা যায়। তিনি নিজেও বলেছেন, অনেকেই তাকে বলেছেন এত অল্প বাজেটে নির্বাচন করা অসম্ভব। কিন্তু তার যুক্তি, নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাইলে এই ‘অসম্ভব’ পথেই হাঁটতে হবে।
এই বক্তব্যের ভেতর এক ধরনের আদর্শবাদ আছে, যা বাংলাদেশের বাস্তব রাজনীতিতে অনেক সময় নিষ্পাপ বা অবাস্তব বলে খারিজ হয়ে যায়। কিন্তু আদর্শবাদ যে একেবারে মূল্যহীন নয়, এই অনুদানের ঢল তা দেখিয়েছে। একই সঙ্গে এটি একটি পরীক্ষাও—এই আদর্শবাদ বাস্তবে কতদূর টিকে থাকতে পারে, সেটিই এখন দেখার বিষয়। নির্বাচনী মাঠে পেশিশক্তি, প্রচলিত প্রচারণা আর প্রভাবশালী নেটওয়ার্কের সামনে সাধারণ মানুষের ছোট অনুদানের শক্তি কতটা কার্যকর হয়, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা।
তাসনিম জারা তার পোস্টে যে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট করেছেন, তা হলো স্বচ্ছতার দাবি। তিনি জানিয়েছেন, যে দুইটি অ্যাকাউন্টে টাকা আসছে, সেগুলো একদম নতুন এবং শূন্য থেকে শুরু হয়েছে। প্রতিটি লেনদেনের হিসাব তিনি প্রকাশ করবেন। এই স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি শুধু আইনগত বাধ্যবাধকতা নয়, বরং এই পুরো উদ্যোগের নৈতিক ভিত্তি। যদি এই স্বচ্ছতা বজায় থাকে, তবে তা ভবিষ্যতে অন্যদের জন্যও একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে।
এই ঘটনার তাৎপর্য তাই শুধু একটি আসনের নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে—রাজনীতি কি সত্যিই সাধারণ মানুষের হাতছাড়া হয়ে গেছে, নাকি এখনো সেই রাজনীতি ফিরিয়ে আনার সুযোগ আছে? তাসনিম জারার অনুদান সংগ্রহের ঘটনা অন্তত দেখিয়েছে, সুযোগ তৈরি হলে মানুষ সাড়া দেয়। সেই সাড়া কতটা স্থায়ী হবে, কতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে, তা সময়ই বলবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন একদিনে আসে না। এখানে প্রতিটি নতুন উদ্যোগকে পাড়ি দিতে হয় সন্দেহ, সমালোচনা ও বাস্তবতার কঠিন দেয়াল। তবু কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে, যা ভবিষ্যতের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। তাসনিম জারার ফেসবুক স্ট্যাটাসের পর বানের পানির মতো টাকা আসার ঘটনাটি ঠিক তেমনই এক মুহূর্ত। এটি হয়তো পুরো ব্যবস্থাকে বদলে দেবে না, কিন্তু এটি দেখিয়ে দিয়েছে—রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি।
এই আস্থাকে ধরে রাখা, তাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এবং নির্বাচনের পরও সেই নৈতিক অবস্থানে অটল থাকা—এগুলোই হবে আসল চ্যালেঞ্জ। যদি তা সম্ভব হয়, তবে এই ছোট ছোট অনুদানের গল্প হয়তো একদিন বাংলাদেশের রাজনীতির পাঠ্যপুস্তকে নতুন একটি অধ্যায় হিসেবে জায়গা করে নেবে। আর যদি সম্ভব না হয়, তবু এই মুহূর্তটি মনে করিয়ে দেবে, এক সময় মানুষ পাঁচ টাকার নোট হাতে নিয়ে ভেবেছিল—রাজনীতি বদলানো
আপনার মতামত জানানঃ