সুনালি খাতুন যখন ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কথা বলেন, তার চোখের জল শুধু ব্যক্তিগত বেদনার নয়, তা যেন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভেতরে হারিয়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষের মুখ হয়ে ওঠে। “আমরা বাংলাদেশি নই, আমরা ভারতীয়। আমাদের সঙ্গে এমন কেন করা হলো?”—এই প্রশ্নের ভেতরে লুকিয়ে আছে আতঙ্ক, ক্ষোভ, অসহায়ত্ব আর গভীর অনিশ্চয়তা। পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র গৃহকর্মীর জীবনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা এখন আর শুধু একটি পরিবারের গল্প নয়, এটি নাগরিকত্ব, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও মানবাধিকারের জটিল সংঘাতের প্রতীক।
২৫ বছর বয়সী সুনালি খাতুন তখন অন্তঃসত্ত্বা। জুন মাসে দিল্লিতে তিনি তার স্বামী দানিশ শেখ ও আট বছরের ছেলের সঙ্গে আটক হন। অভিযোগ—তারা অবৈধভাবে ভারতে বসবাস করছেন, তারা নাকি বাংলাদেশি। কোনো আদালতের রায় নয়, কোনো চূড়ান্ত যাচাই নয়—এই সন্দেহই যথেষ্ট ছিল তাদের জীবন ও পরিচয় ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার জন্য। কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সীমান্ত পার হওয়ার সেই মুহূর্ত থেকে সুনালির জীবন আর আগের মতো থাকেনি।
বাংলাদেশে ঢোকার পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। অবৈধভাবে দেশে প্রবেশের অভিযোগে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ তাদের কারাগারে পাঠায়। অন্তঃসত্ত্বা সুনালি, তার ছোট ছেলে—দুজনেই বন্দি হয়ে পড়ে এক অচেনা দেশের কারাগারে। প্রায় ১০০ দিনের বেশি সময় তারা সেখানে ছিলেন। সুনালি বলেন, কারাগারের খাবার ছিল অপর্যাপ্ত, তার সেলে কোনো শৌচাগার ছিল না। একজন গর্ভবতী নারীর জন্য এই অবস্থা ছিল শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার মতো। “আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। আমার সঙ্গে শুধু আমার ছেলে ছিল। আমরা শুধু কাঁদতাম,”—এই কথার ভেতর দিয়ে ফুটে ওঠে এক মায়ের অসহায় লড়াই।
এই ঘটনাটি দ্রুত জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার জন্ম দেয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের তীব্র সমালোচনা করে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ তোলেন, কোনো কারণ ছাড়াই একজন ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দিল্লি সরকার এসব নির্বাসনের বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি। অথচ বাংলাদেশের সরকারি উচ্চপর্যায়ের সূত্র এর আগেই বিবিসিকে জানিয়েছিল, শুধু মে মাসেই ১,২০০ জনের বেশি মানুষকে ‘অবৈধভাবে ঠেলে’ বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। অল ইন্ডিয়া রেডিওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দিল্লি থেকে প্রায় ৭০০ জনকে ফেরত পাঠানো হয়। সংখ্যাগুলো ইঙ্গিত দেয়, সুনালি খাতুন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নন; তিনি একটি বৃহত্তর অভিযানের অংশ।
ভারত ও বাংলাদেশের দীর্ঘ, তুলনামূলকভাবে খোলা সীমান্ত বহু দশক ধরে মানুষের যাতায়াত দেখেছে। কাজের সন্ধান, দারিদ্র্য, কখনো ধর্মীয় নিপীড়ন—বিভিন্ন কারণে মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের উপস্থিতি তাই নতুন নয়। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ, সাম্প্রতিক অভিযানে বিশেষভাবে টার্গেট করা হচ্ছে বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের। ভাষা ও ধর্ম—এই দুই পরিচয় মিলেই যেন সন্দেহের প্রধান ভিত্তি হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই পুরো প্রক্রিয়ায় যথাযথ আইনি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠছে।
নিয়ম অনুযায়ী, কাউকে অবৈধ অভিবাসী সন্দেহে আটক করলে তার দাবি যাচাইয়ের জন্য নিজ রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা। পশ্চিমবঙ্গ অভিবাসী শ্রমিক কল্যাণ বোর্ডের চেয়ারম্যান সামিরুল ইসলাম স্পষ্ট করে বলেছেন, সুনালি খাতুনের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া মানা হয়নি। অর্থাৎ, তাকে ভারতীয় নাগরিক কি না—এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগেই তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নাগরিকত্বের মতো মৌলিক বিষয়ের ক্ষেত্রে এমন তাড়াহুড়ো এবং অবহেলা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে।
এই সময় সুনালির পরিবার পশ্চিমবঙ্গে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছিল। তাদের লক্ষ্য একটাই—প্রমাণ করা যে সুনালি ভারতীয় নাগরিক এবং তাকে ফিরিয়ে আনা। অবশেষে ডিসেম্বর মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মানবিক কারণে সুনালি ও তার ছেলেকে ভারতে ফেরার অনুমতি দেয়। যদিও নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়া তখনও চলমান, তবু এই রায় ছিল তার জীবনে সামান্য স্বস্তির নিশ্বাস। তিনি এখন পশ্চিমবঙ্গে তার বাবা-মায়ের এক কামরার ঘরে থাকছেন।
কিন্তু এই স্বস্তি অসম্পূর্ণ। তার স্বামী দানিশ শেখ এখনো বাংলাদেশে। জামিনে মুক্তি পেলেও তিনি সেখানে এক আত্মীয়ের সঙ্গে থাকছেন এবং দেশে ফিরতে পারছেন না। তিন মাসের বেশি সময় ধরে স্বামী-স্ত্রীর দেখা হয়নি। ভিডিও কলে কথা বলার সময় দানিশ প্রায়ই ভেঙে পড়েন, বলেন তিনি বাড়ি ফিরতে চান। পর্দার দুই পাশে থাকা এই দম্পতির চোখের জল যেন সীমান্তের চেয়েও গভীর এক দূরত্ব তৈরি করেছে।
সুনালির জন্য সবচেয়ে বড় ভয় ছিল তার অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ। তিনি বারবার বলেছেন, বাংলাদেশে সন্তান জন্মালে তার নাগরিকত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতো। এখন তিনি স্বস্তি পাচ্ছেন এই ভেবে যে, জানুয়ারিতে জন্মাতে যাওয়া শিশুটি জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক হবে। কিন্তু একই সঙ্গে উদ্বেগও বাড়ছে—স্বামী ছাড়া, অনিশ্চিত আয় আর ভাঙা মানসিক অবস্থায় কীভাবে তিনি তিন সন্তানকে বড় করবেন?
এই পুরো ঘটনায় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের ভূমিকা নিয়েও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। সুনালির দাবি, দিল্লিতে আটক হওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ পর তাদের বিমানে করে সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয় এবং জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, তাদের একটি ঘন জঙ্গলে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যেখানে নদী আর খাল ছিল। স্থানীয়দের সাহায্যে ভারতে ফেরার চেষ্টা করলে বিএসএফ সদস্যরা তাদের মারধর করে আবার জঙ্গলে ফিরিয়ে দেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে বিবিসি বিএসএফের কাছে প্রশ্ন পাঠালেও এখনো কোনো চূড়ান্ত জবাব পাওয়া যায়নি।
জঙ্গলে ফেলে দেওয়ার পর স্থানীয়দের সহায়তায় তারা ঢাকায় পৌঁছান। সেখানে কয়েক দিন খাবার ও পানি ছাড়া ঘুরে বেড়ানোর পর গ্রেপ্তার হন। এই অভিজ্ঞতা শুধু শারীরিক কষ্টের নয়, মানসিকভাবে চূর্ণ হওয়ার মতো। একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী, একটি শিশু—রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ফাঁকফোকরে পড়ে কীভাবে তারা বেঁচে ছিলেন, তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়।
সুনালির গল্প আমাদের সামনে একটি বড় প্রশ্ন রেখে যায়—নাগরিকত্ব কি কেবল কাগজের প্রমাণ? ভাষা, ধর্ম বা চেহারার ভিত্তিতে কি একজন মানুষের দেশ নির্ধারিত হবে? রাষ্ট্র যদি ভুল করে, সেই ভুলের দায় কে নেবে? একজন সাধারণ গৃহকর্মীর পক্ষে কি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় প্রমাণ করা সম্ভব?
পশ্চিমবঙ্গে বাবা-মায়ের ছোট ঘরে বসে সুনালি যখন বলেন, “আমার পরিবার পুরোপুরি ভেঙে গেছে,” তখন সেই কথার ওজন শুধু তার পরিবারের নয়, বরং অসংখ্য প্রান্তিক মানুষের বাস্তবতা বহন করে। তিনি জানেন, এখানে থাকলে হয়তো তিন বেলা ঠিকমতো খাবার জুটবে না। তবু তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, তিনি আর কখনো দিল্লিতে ফিরবেন না। দিল্লি তার কাছে এখন শুধু একটি শহর নয়, এটি এক ভয়াবহ স্মৃতির নাম—যেখানে একটি রাষ্ট্র তাকে তার পরিচয় থেকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল।
সুনালি খাতুনের গল্প শেষ হয়নি। তার স্বামী এখনো অন্য দেশে, তার নাগরিকত্ব এখনো যাচাইাধীন। কিন্তু তার কণ্ঠে উচ্চারিত প্রশ্ন—“আমরা ভারতীয়, আমাদের সঙ্গে এমন কেন করা হলো?”—এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুধু সুনালির জন্য নয়, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের আত্মপরিচয়ের জন্যও জরুরি।
আপনার মতামত জানানঃ