বাংলাদেশের আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত ও জটিল প্রশ্নগুলোর একটি হয়ে দাঁড়িয়েছে—জাতীয় পার্টি আদৌ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের মিত্র হিসেবে পরিচিত দলটি এখন একদিকে রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে, অন্যদিকে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছে। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করার পর রাজনীতি যখন স্পষ্টভাবে নির্বাচনমুখী, তখনো জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। এই অনিশ্চয়তা শুধু দলগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো রাজনৈতিক পরিসরে, যেখানে অংশগ্রহণ, বর্জন, নিষেধাজ্ঞা ও নিরাপত্তা—সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে।
জাতীয় পার্টি বিগত তিনটি জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা এবং সংসদে তাদের কার্যক্রমের ধরন জাতীয় পার্টিকে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটি বড় অংশ মনে করেন। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে এই দলটি সরকারবিরোধী শক্তি হিসেবে দৃশ্যমান কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। বরং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতার রাজনীতির মধ্য দিয়েই তারা সংসদীয় রাজনীতিতে টিকে ছিল। ফলে আওয়ামী লীগের পতনের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে জাতীয় পার্টির গায়ে লেগেছে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ তকমা। এই তকমাই এখন তাদের জন্য সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতি ঘটার পর অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে জাতীয় পার্টিকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় নানা বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। দলীয় কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বাধা, হামলার শঙ্কা, এমনকি দল নিষিদ্ধের দাবি—সব মিলিয়ে জাতীয় পার্টি কার্যত একটি প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদসহ একাধিক দল প্রকাশ্যেই জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে। তাদের যুক্তি হলো, আওয়ামী লীগের শাসন টিকিয়ে রাখতে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে। সুতরাং নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এসব দলকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলে তা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার পরিপন্থী হবে।
এই কঠোর অবস্থানের বিপরীতে বিএনপির অবস্থান তুলনামূলকভাবে নমনীয়। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য ও দলীয় সূত্রগুলোর ইঙ্গিত থেকে বোঝা যায়, তারা এমন কোনো অবস্থান নিতে চাইছে না যাতে নির্বাচন নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়। বিএনপির একটি বড় অংশ মনে করছে, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় নির্বাচন হলে তাদের বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের সম্ভাবনা প্রবল। সে কারণে তারা নির্বাচনের অন্তর্ভুক্তি প্রশ্নে সরাসরি বাধা হয়ে দাঁড়াতে আগ্রহী নয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, যেসব দলের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ নয় এবং আইনগতভাবে কোনো বাধা নেই, তাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি থাকার কথা নয়। এই বক্তব্য জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশগ্রহণের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি নাকচ করে না।
তবে বিএনপির এই নমনীয়তার পেছনে কৌশলগত কারণও রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বর্তমানে সক্রিয় দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির জন্য একটি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের সংগঠনে জামায়াতের সক্রিয়তা বিএনপির জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিলে জামায়াতের ভোট কিছুটা বিভক্ত হতে পারে—এই হিসাবও বিএনপির কৌশলে কাজ করছে বলে ধারণা করা হয়। যদিও একই সঙ্গে জামায়াত ও এনসিপির কঠোর অবস্থানের কারণে বিএনপি প্রকাশ্যে জাতীয় পার্টির পক্ষে অবস্থান নিতে চাইছে না। তারা বরং পুরো বিষয়টির দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ছেড়ে দিতে চায়।
জামায়াতে ইসলামী এই প্রশ্নে সবচেয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। দলটি শুধু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাখার দাবিতেই অনড় নয়; বরং দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিও তারা তুলছে। জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থি দলগুলোর জোট থেকে জাতীয় পার্টিসহ আওয়ামী লীগের মিত্র অন্যান্য দলগুলোর রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিও উঠেছে। জামায়াত নেতাদের বক্তব্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসন টিকে থাকার পেছনে এসব মিত্র দলের অবদান রয়েছে। ফলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাদের আবার নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হলে তা জনগণের আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হবে।
এনসিপিও একই সুরে কথা বলছে। জুলাই আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্বের একাংশের হাত ধরে গড়ে ওঠা এই দলটির রাজনীতির মূল ভিত্তিই হলো আওয়ামী লীগবিরোধিতা। এনসিপির নেতারা স্পষ্ট করে বলেছেন, আওয়ামী লীগ এবং তাদের সহযোগীরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। জাতীয় পার্টিকেও তারা সেই সহযোগী শক্তির অংশ হিসেবে দেখছে। ফলে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিলে মাঠপর্যায়ে তাদের প্রচারণা নির্বিঘ্নে চালানো সম্ভব হবে কি না—সে প্রশ্ন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই রাজনৈতিক চাপের মধ্যেও জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করছে। দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের স্পষ্ট করে বলেছেন, একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া তাদের অধিকার। তার যুক্তি হলো, আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে যদি নির্বাচন হয় এবং জাতীয় পার্টিও যদি সেই নির্বাচনে না থাকে, তাহলে দেশ-বিদেশে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। সেই সঙ্গে জাতীয় পার্টির ভেতরেও রয়েছে অস্তিত্ব সংকট। অতীতে একাধিক ভাঙনের ফলে দলটি বিভিন্ন অংশে বিভক্ত হয়েছে, যারা সবাই নিজেদের মূল জাতীয় পার্টি বলে দাবি করে। সাম্প্রতিক সময়ে জিএম কাদেরের নেতৃত্বের বিরোধিতা করে আরেকটি অংশ আলাদা দল গঠন করেছে। উভয় পক্ষই নির্বাচনে অংশ নিতে চায়, যা জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাকেই সামনে আনে।
নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগ্রহের পাশাপাশি জাতীয় পার্টির বড় উদ্বেগের জায়গা হলো নিরাপত্তা। সাম্প্রতিক সময়ে ইনকিলাব মঞ্চের নেতা শরিফ ওসমান হাদির ওপর হত্যাচেষ্টার ঘটনার পর নির্বাচন ঘিরে নিরাপত্তা প্রশ্নে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। শুধু জাতীয় পার্টি নয়, জামায়াত ও এনসিপিসহ সরকারঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত দলগুলোর মধ্যেও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। যদিও সরকার ও নির্বাচন কমিশন বারবার আশ্বাস দিচ্ছে যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, মাঠের বাস্তবতা নিয়ে রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকদের মধ্যে সংশয় কাটেনি।
এই পুরো প্রেক্ষাপটে জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নটি শুধু একটি দলের ভাগ্য নির্ধারণের বিষয় নয়; বরং এটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক রূপান্তরের একটি প্রতীক। একদিকে রয়েছে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের দাবি, অন্যদিকে রয়েছে অতীতের দায় ও রাজনৈতিক নৈতিকতার প্রশ্ন। জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হলে সেটি কি গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে, নাকি একটি বহুদলীয় নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করবে—এই দ্বন্দ্ব এখনো মীমাংসিত নয়। শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার কোন পথে হাঁটবে, নির্বাচন কমিশন কী সিদ্ধান্ত নেবে এবং মাঠের রাজনীতি কোন দিকে মোড় নেবে—তার ওপরই নির্ভর করছে জাতীয় পার্টির নির্বাচনী ভবিষ্যৎ। এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের দিকে, যেখানে অংশগ্রহণ ও বর্জনের প্রশ্ন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেই যাবে।
আপনার মতামত জানানঃ