১৪ ডিসেম্বর সিডনির বন্ডাই সমুদ্রসৈকত ছিল আলো, উৎসব আর মানুষের মিলনের প্রতীক। ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের আলোক উৎসব হানুক্কাহ উপলক্ষে সেখানে জড়ো হয়েছিলেন হাজারের বেশি মানুষ—পরিবার, শিশু, প্রবীণ, পর্যটক। সমুদ্রের হাওয়া, আলোঝলমল পরিবেশ আর উৎসবের উষ্ণতায় কেউ ভাবতেও পারেননি, এই আনন্দের মাঝখানেই নেমে আসবে অস্ট্রেলিয়ার গত তিন দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ রক্তপাত। দুই বন্দুকধারীর নির্বিচার গুলিতে মুহূর্তের মধ্যে নিভে যায় ১৫টি প্রাণ। আনন্দ রূপ নেয় আর্তচিৎকারে, আতঙ্কে, রক্তে। সেই রাত শুধু সিডনির নয়, পুরো বিশ্বের মানবিক বিবেককে নাড়িয়ে দেয়।
এই হামলার পর সিডনির আকাশে বাতাসে নেমে আসে এক অদ্ভুত স্তব্ধতা। শোক, ভয় আর অনিশ্চয়তা যেন শহরের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এই শোকের চেয়েও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আরেকটি বিষ—তকমা লাগানোর রাজনীতি। কে ছিল হামলাকারী, তার ধর্ম কী, তার পরিচয় কোথা থেকে এসেছে—এই প্রশ্নগুলো যেন নিহতদের নাম, তাদের পরিবারের কান্না, আহতদের যন্ত্রণা—সবকিছুকে ছাপিয়ে যেতে থাকে। মানবিক ট্র্যাজেডি ক্রমে পরিণত হয় রাজনৈতিক বয়ানের অস্ত্রে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি আলবানিজ যখন জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানান, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় নজিরবিহীন ‘ন্যারেটিভ যুদ্ধ’। এক পক্ষ এই হামলাকে ব্যবহার করতে চায় ইসলামভীতি ছড়ানোর জন্য, অন্য পক্ষ এটিকে ইহুদিবিদ্বেষের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করে। কেউ কেউ আবার এটিকে ‘ফলস ফ্ল্যাগ’ বলে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দাঁড় করাতে ব্যস্ত। এই সব তর্ক-বিতর্কে এক মুহূর্তের জন্যও যেন গুরুত্ব পায় না সেই মৌলিক সত্যটি—এই হামলায় মারা গেছে মানুষ, আহত হয়েছে মানুষ, আর যারা বাঁচিয়েছে তারাও মানুষ।
এই অন্ধকার সময়েই এক উজ্জ্বল মানবিক আলোর নাম উঠে আসে—আহমেদ আল আহমেদ। ৪৩ বছর বয়সী এই ফল ব্যবসায়ী সেদিন কোনো নায়ক হওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হননি। তিনি ছিলেন উৎসবের ভিড়ের একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু যখন গুলির শব্দে চারপাশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, মানুষ যখন প্রাণ বাঁচাতে দিগ্বিদিক ছুটছে, তখন আহমেদ পালাননি। খালি হাতে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এক সশস্ত্র হামলাকারীর ওপর। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বন্দুক কেড়ে নেওয়ার সেই মুহূর্তে তিনি কোনো ধর্ম, কোনো জাতি, কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ভাবেননি। তিনি ভেবেছিলেন শুধু একটি কথাই—মানুষকে বাঁচাতে হবে।
এই সাহসিকতার মূল্য তাঁকে দিতে হয়েছে নিজের শরীরে। দুটি গুলির ক্ষত নিয়ে তিনি এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কিন্তু এই ক্ষত শুধু একজন মানুষের শরীরের ক্ষত নয়, এগুলো আমাদের সমাজের ঘৃণার ক্ষত সারানোর এক বিরল সুযোগ। আহমেদের এই কাজ মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে দিয়েছে ‘আমরা বনাম তারা’ এই বিভাজনের সহজ সমীকরণ। কারণ, যদি হামলাকারী মুসলমান হয়ে থাকে, তবে সেই হামলাকারীকে থামিয়ে দেওয়া প্রথম মানুষটিও ছিলেন একজন মুসলমান।
আহমেদ আল আহমেদ একজন সিরীয় অভিবাসী। এক দশক আগে তিনি নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন সন্ত্রাসবাদের আগুন থেকে বাঁচতে। সিরিয়ার যুদ্ধ তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে নিরাপত্তা, স্থিতি, স্বাভাবিক জীবন। অস্ট্রেলিয়া তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিল নতুন করে বাঁচার সুযোগ। ফলের ব্যবসা করে, পরিশ্রম করে তিনি গড়ে তুলেছিলেন শান্ত একটি জীবন। সেই মানুষটাই আবার সন্ত্রাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রমাণ করলেন—সহিংসতার বিপরীতে দাঁড়ানোর শক্তি আসে মানবতা থেকে, পরিচয় থেকে নয়।
অন্যদিকে, হামলাকারী হিসেবে যাদের নাম সামনে এসেছে, তারাও অভিবাসনের গল্প বহন করে। সাজিদ আকরাম ১৯৯৮ সালে শিক্ষার্থী ভিসায় অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলেন, তাঁর ছেলে নবীদ আকরাম এই দেশেরই বাস্তবতায় বড় হয়েছে। এই বাস্তবতা আমাদের শেখায়, সন্ত্রাস কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম, জাতি বা অভিবাসন অবস্থার একচেটিয়া পরিচয় নয়। সন্ত্রাস ব্যক্তি ও আদর্শের বিকৃতি, সমাজের ব্যর্থতা, ঘৃণার চর্চার ফল।
তবু আমরা বারবার সেই সহজ পথে হাঁটি—মানুষকে দ্বিমাত্রিক ছকে ফেলতে চাই। হয় সে আমাদের, নয় সে তাদের। হয় সে ভালো, নয় সে খারাপ। এই বাইনারি দৃষ্টিভঙ্গিই সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড় সহায়ক। কারণ এতে করে একজন অপরাধীর কাজের দায় গিয়ে পড়ে পুরো একটি গোষ্ঠীর ওপর। আহমেদ আল আহমেদের সাহসিকতা এই চিন্তার কাঠামোকে ভেঙে দিয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, শয়তান যেমন সর্বত্র থাকতে পারে, তেমনি মানবতাও সর্বত্র বিরাজমান।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ট্র্যাজেডিকেও রাজনৈতিক পুঁজি বানানোর চেষ্টা থামেনি। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরাসরি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করে একে ক্রমবর্ধমান ইহুদিবিদ্বেষের ফল বলে অভিহিত করেছেন। এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক কূটনীতির উত্তেজনা বাড়িয়েছে, কিন্তু বন্ডাইয়ের মাটিতে পড়ে থাকা রক্তের ব্যথা কমায়নি। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ষড়যন্ত্রতত্ত্ব—এই হামলা নাকি সাজানো নাটক—ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর কষ্টকে আরও তীব্র করেছে। ইতিহাসে ১৯৫০-এর দশকে ইরাকের ইহুদিদের সঙ্গে যা ঘটেছিল, তার সঙ্গে তুলনা টানা যেতে পারে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, কিন্তু আজ বন্ডাইয়ের রক্ত কোনো গল্প নয়, কোনো রাজনৈতিক কৌশল নয়—এটি ১৫টি পরিবারের চিরস্থায়ী শোক।
এই ঘটনার পর অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসীদের প্রতি সন্দেহ আরও তীব্র হবে—এটা অস্বীকার করা কঠিন। বিশেষ করে বাদামি চামড়ার মানুষ, তারা ভারতীয় হোক, পাকিস্তানি কিংবা বাংলাদেশি—ভিসা, চাকরি, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে বাড়তি প্রশ্নের মুখে পড়বে। অস্ট্রেলিয়ার মতো বহুসাংস্কৃতিক, উদার রাষ্ট্রেও যদি ধর্ম বা উৎপত্তিস্থলের ভিত্তিতে তকমা লাগানোর চর্চা জোরদার হয়, তবে তা শুধু অভিবাসীদের নয়, পুরো সমাজের জন্যই বিপজ্জনক।
সিডনি থেকে বসে এই সময়টাকে দেখলে মনে হয়, আমরা যেন মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে ভুলে যাচ্ছি। আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি ঘাতকের ধর্ম খুঁজতে, তার নামের অর্থ বিশ্লেষণ করতে, তার পরিচয় দিয়ে রাজনৈতিক তর্ক জিততে। অথচ আমরা ভুলে যাচ্ছি সেই মানুষটির কথা, যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যদের বাঁচিয়েছেন। আহমেদ আল আহমেদের শরীরে আজ দুটি গুলির ক্ষত, কিন্তু তাঁর সাহস আমাদের সামনে এক আয়না ধরে দিয়েছে। প্রশ্নটি খুব সরল—আমরা কোন গল্পটা ছড়িয়ে দেব? ঘৃণার গল্প, না মানবতার গল্প?
প্রধানমন্ত্রী আলবানিজ যদি সত্যিই জাতীয় ঐক্য চান, তবে আহমেদের মতো নায়কদের গল্প রাষ্ট্রীয়ভাবে তুলে ধরা জরুরি। স্কুলে, গণমাধ্যমে, জনপরিসরে এই গল্পগুলো ছড়াতে হবে। কারণ তরুণ প্রজন্ম যদি বারবার শুধু ঘাতকের নাম শোনে, তবে তারা শিখবে ঘৃণা। আর যদি তারা শুনতে পায় একজন সাধারণ ফল ব্যবসায়ীর সাহসের গল্প, তবে তারা শিখবে মানবতা।
সন্ত্রাসবাদের কোনো ধর্ম নেই, কোনো দেশ নেই। যে সন্ত্রাস ছড়িয়েছে, তার বিচার ও কঠোরতম শাস্তি হওয়াই উচিত। কিন্তু সেই সঙ্গে যারা এই রক্তপাতকে ব্যবহার করে ঘৃণার রাজনীতি করছে, তাদেরও পরাজিত করা জরুরি। ঘৃণার বয়ান যত শক্তিশালী হবে, সন্ত্রাসবাদ তত বেশি সফল হবে। কারণ সন্ত্রাসের চূড়ান্ত লক্ষ্য শুধু প্রাণহানি নয়, সমাজকে বিভক্ত করা, মানুষকে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করা।
আহমেদ আল আহমেদ আমাদের দেখিয়েছেন, মানবতা রক্ষা করার জন্য কোনো বিশেষ পরিচয়ের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় সাহস, সহমর্মিতা আর অন্যের জীবনের মূল্য বোঝার ক্ষমতা। এখন দায়িত্ব আমাদের—এই শিক্ষা আমরা ধারণ করব কি না। আমরা কি বিভাজনের রাজনীতি থামাব, নাকি তাতে নীরব সম্মতি দেব? মানুষকে কেবল মানুষ হিসেবেই সম্মান করতে শিখব, নাকি তকমার ভেতর বন্দী করে রাখব?
বন্ডাইয়ের সেই রক্তাক্ত সন্ধ্যা আমাদের সামনে এক কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তরই ঠিক করবে, আমরা কোন পথে যাব—ঘৃণার পথে, না মানবতার পথে। আহমেদ আল আহমেদের ক্ষত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এখনো মানবতা বেঁচে আছে। প্রশ্ন শুধু একটাই—আমরা কি তাকে বাঁচিয়ে রাখব?
আপনার মতামত জানানঃ