শ্রীলঙ্কা আজ এক গভীর মানবিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। ঘূর্ণিঝড় দিতওয়ার আঘাত, তার পরবর্তী টানা বৃষ্টি, ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধস—সব মিলিয়ে দেশটির জনজীবন কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। তিন দিনব্যাপী অঝোর বর্ষণে দ্বীপদেশটির ২৫টি জেলার বড় অংশ পানিতে ডুবে যায়। বিদ্যুৎ–বিভ্রাট, রাস্তাঘাট ভেঙে পড়া, যোগাযোগ ব্যবস্থার পঙ্গুত্ব এবং সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এক অচিন্তনীয় দুর্যোগে রূপ নিয়েছে। এক দশকের মধ্যে এমন ধ্বংসযজ্ঞ আর দেখা যায়নি। সরকারি হিসাবে অন্তত ৪১০ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেছে, আর এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ৩৩৬ জনের বেশি। বহু জায়গায় ভূমিধসের সম্ভাবনা এখনো তীব্র, এজন্য রেড অ্যালার্ট বহাল রয়েছে। মানুষ অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মানুষ গাদাগাদি করে দিন কাটাচ্ছে; সেখানেও নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য ও ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যের চরম সংকট।
এ রকম দুর্যোগে সাধারণত আন্তর্জাতিক সহায়তার হাত দ্রুত পৌঁছে যায়। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো আগেই মাঠে নেমেছে, প্রতিবেশী দেশগুলোও বিভিন্নভাবে সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। তবে সব সহায়তাই সমান কার্যকর বা উপযোগী হয় না—এরও কিছু বিচিত্র উদাহরণ রয়েছে। যেমন একটি দেশের পক্ষ থেকে পাঠানো ‘পূর্ব সংরক্ষিত’ খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য পাওয়া গেছে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার কর্মকর্তারা এটিকে ‘সহায়তা কূটনীতির প্রহসন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবার নেপালে ভূমিকম্পের সময় এক প্রতিবেশী দেশ টিনজাত গরুর মাংস পাঠিয়ে যে সাংস্কৃতিক অসংবেদনশীলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, তার কথাও অনেকের মনে রয়েছে। দুর্যোগের সময় সঠিক সহায়তা শুধু মানবিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলনই নয়, বরং তা একটি দেশের ভাবমূর্তি, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং ভবিষ্যতের বাণিজ্যিক পরিবেশেও প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশও শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিন আগে বিমানযোগে পাঠানো দশ টন ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে তাঁবু, শুকনো খাবার, মশারি, টর্চলাইট, গামবুট, ভেস্ট, হাতমোজা, উদ্ধারকর্মীর হেলমেট এবং বিপুল পরিমাণ জরুরি ওষুধ ছিল। পরিমাণে কম হলেও এগুলো সংকটমুহূর্তে কার্যকর। এই সহায়তা প্রাথমিক জরুরি চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখবে, যদিও জাতিসংঘের সাম্প্রতিক মূল্যায়নে স্পষ্ট যে শ্রীলঙ্কার খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি দুর্যোগের আগে থেকেই গুরুতর সংকটে ছিল। ভয়াবহ খরার কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ায় খাদ্যের দাম দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এখন তো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সেই সংকট বহুগুণ বাড়বে। ১৫ লাখের বেশি মানুষ মাঝারি থেকে উচ্চ মাত্রার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে আছে, যা আরও বিস্তৃত হতে পারে। শাকসবজির দাম ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে, চাল ও ডালের দামও বাড়ছে। কৃষক ও জেলেরা বিপর্যয়ের মধ্যে আক্ষরিক অর্থেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না; তাদের সহায়তা না পেলে আগামী মৌসুম পর্যন্ত উৎপাদন ব্যবস্থাই ভেঙে পড়তে পারে।
এই পুরো প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য এক অদ্ভুত কিন্তু বাস্তব সুযোগ তৈরি হয়েছে—সেটি হলো শ্রীলঙ্কায় আলু পাঠানো, মানবিক ত্রাণ হিসেবেই হোক বা কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের কৌশল হিসেবেই হোক। ঢাকায় যখন নতুন আলুর কেজি ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এবং হিমাগারের আলু ৩০ টাকার নিচে নেমে গেছে, তখন শ্রীলঙ্কায় প্রতি কেজি আলুর দাম ৫০০ রুপির কাছেও নেই; বন্যার আগেও ছিল ৪০০ রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৫৮ টাকা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশটি বছরে প্রায় ২ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন আলু ব্যবহার করেছে এবং খাদ্যসংকট বাড়লে এ ব্যবহার আরও বাড়তে পারে। মাথাপিছু বছরে ৮ কেজির বেশি আলু খায় শ্রীলঙ্কাবাসী। তাদের মোট আমদানিকৃত আলুর পাঁচ ভাগের এক ভাগই যায় বাংলাদেশ থেকে। অর্থাৎ আমাদের এখানে যে আলুকে মূল্যহীন করে ফেলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কায় সেটিই এখন অত্যন্ত চাহিদাসম্পন্ন পণ্য।
বাণিজ্যিক সম্পর্কের এই মাত্রা নতুন নয়। গত আগস্টে কলম্বোয় অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়া ট্রেড ফেয়ারে বাংলাদেশি আলু প্রচুর আগ্রহ কুড়িয়েছিল। উদ্বোধনী দিনে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী দীনেশ গুনাবর্ধনে নিজে বাংলাদেশ স্টলে গিয়ে উৎপাদকদের ধন্যবাদ জানান। তিনি আমাদের দেশে উৎপাদিত আলুর বিভিন্ন জাত, তাদের পুষ্টিগুণ এবং প্রতিযোগিতামূলক দামের তথ্য জেনে আগ্রহ প্রকাশ করেন। অর্থাৎ বাজার ইতিমধ্যেই তৈরি হতে শুরু করেছে; এখন দরকার সঠিক কৌশল ও সময়োপযোগী উপস্থিতি।
বাংলাদেশে আলু উৎপাদন এখনো কৃষকের বড় একটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নীতিনির্ধারণী ভুল, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং সংরক্ষণব্যবস্থার অসামঞ্জস্যতার কারণে চাষিদের লোকসান সহ্য করতে হচ্ছে। অনেকে আলুচাষ থেকে সরে যাওয়ার কথাও ভাবছেন। যে দেশে খাদ্যনিরাপত্তার কথা এত বলা হয়, সেখানে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যপণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা ঝুঁকিতে পড়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। অতিরিক্ত উৎপাদনের সমস্যাকে আমরা সবসময় নেতিবাচক হিসেবে দেখি, অথচ সঠিক বাজার খুঁজে পেলে এই উদ্বৃত্ত বিপুল সম্পদে পরিণত হতে পারে। বিশেষত যখন প্রতিবেশী একটি দেশে ভয়াবহ খাদ্যসংকট চলছে এবং বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে সস্তা ও মানসম্মত আলুর সম্ভাব্য উৎস।
এখানেই আসে “আলু কূটনীতি”-র ধারণাটি। মানবিক সহায়তা হিসেবে আলু পাঠানো প্রথমত একটি সহমর্মিতার পরিচয়। দুর্যোগের সময় পাশে দাঁড়ানো—এ অনুভূতি কখনো মূল্যহীন হয়ে যায় না। অতীতে নেপালে বিমানযোগে তেল পাঠানোর সময়ও একই আলোচনা উঠেছিল। পরিমাণে অল্প হলেও এই সহায়তা নেপালের মানুষের মনে ইতিবাচক ছাপ ফেলেছিল এবং পরবর্তী সময়ে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কেও এর প্রতিফলন দেখা গেছে। মানবিক সহযোগিতা প্রায়শই একটি দীর্ঘমেয়াদি বিশ্বাসের ভিত্তি রচনা করে, যার ওপর দাঁড়িয়ে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক মজবুত হয়।
শ্রীলঙ্কায় আলু পাঠানো একইসঙ্গে তিনটি উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে। প্রথমত, তাৎক্ষণিক মানবিক সহায়তা পাওয়া যাবে, যা তাদের খাদ্যসংকটে স্পষ্ট স্বস্তি দেবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশি আলুর মান, স্বাদ ও প্রতিযোগিতামূলক দামের ধারণা আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে, যা পরবর্তী সময়ে রপ্তানিকে টেকসই বাজারে পরিণত করতে সাহায্য করবে। তৃতীয়ত, দেশের আলুচাষিরা লোকসানের হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবেন। তাদের উৎপাদন শৃঙ্খলা ধরে রাখা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। চাষিরা যদি আলুচাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, তাহলে ভবিষ্যতে দেশে আলুর ঘাটতি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা অস্বীকার করা যাবে না। তাই আন্তর্জাতিক বাজার তৈরির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজারকেও স্থিতিশীল রাখা যায়।
তাছাড়া আলু একটি এমন পণ্য, যার দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ ব্যবস্থা আমাদের দেশে আছে, কিন্তু সেগুলোর ব্যবহার পরিকল্পনা নির্ভর করে। অনেক সময় হিমাগারের আলু নষ্ট হয়ে যায়, আবার অতিরিক্ত মজুতের কারণে বাজারে দাম পড়ে গিয়ে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদি এই উদ্বৃত্তকে দ্রুত বের করে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করানো যায়, তাতে কৃষক, রপ্তানিকারক এবং সরকারের তিন পক্ষই লাভবান হবে। শ্রীলঙ্কা এখন এমন এক অবস্থায় আছে যেখানে দ্রুত, সহজে রান্না করা যায় এবং তুলনামূলক সস্তা এমন খাদ্যপণ্যের চাহিদা অত্যন্ত বেশি। আলু সেই শর্ত পূরণ করে।
সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি একজন সহমর্মী, নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী হিসেবে আরও শক্তিশালী হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুধু উচ্চপর্যায়ের আলোচনা বা কূটনৈতিক ভাষণের ওপর দাঁড়ায় না; বাস্তবে বিপদের সময় কে পাশে দাঁড়ায়, সেটিই বড় হয়ে দেখা দেয়। শ্রীলঙ্কার জনগণ এই দুর্যোগের সময় যে দেশ তাদের খাদ্য সহায়তা পাঠাবে, তাদের সেই ঋণ সহজে ভুলবে না। ভবিষ্যতের বাণিজ্য, পর্যটন, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহযোগিতা—সব ক্ষেত্রেই এ ধরনের মানবিক উদ্যোগ প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশের জন্য এটিকে শুধু মানবিক সহায়তা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে দেখা উচিত। আমাদের দেশে উৎপাদনশীল কৃষিকে টিকিয়ে রাখতে হলে আন্তর্জাতিক বাজার বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। আলুর মতো একটি বহুমুখী পণ্যের টেকসই রপ্তানি ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে পারলে ভবিষ্যতে আরও বৈচিত্রপূর্ণ কৃষিপণ্যের বাজার তৈরি করা সহজ হবে। শ্রীলঙ্কার সংকট তাই এক অর্থে বাংলাদেশের জন্যও একটি সুযোগ—একটি সম্ভাবনা তৈরি করার সুযোগ, মানবিক সহায়তাকে কৌশলগত সহযোগিতায় পরিণত করার সুযোগ।
বাংলাদেশ বারবার দেখিয়েছে যে বিশ্বদুর্যোগে পাশে দাঁড়ানোর সক্ষমতা তার আছে। এবার সেই সক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে একটি কার্যকর অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। শ্রীলঙ্কায় আলু পাঠানো যদি সঠিকভাবে সংগঠিত হয়, তবে তা শুধু মানবিক সহমর্মিতার নিদর্শন হিসেবেই নয়, বরং বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির জন্যও নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিতে পারে। এই সহযোগিতা দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর করতে পারে এবং ভবিষ্যতের পারস্পরিক আস্থার ভিত্তি সুদৃঢ় করতে পারে। দুর্যোগের অন্ধকারে বাংলাদেশের আলু হয়তো শ্রীলঙ্কার মানুষের জন্য কিছুটা আলোর মতোই হয়ে উঠবে, আর সেই আলো আমাদের কৃষক এবং অর্থনীতির জন্যও পথ দেখাতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ