বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অদ্ভুত নীরব রূপান্তরের সময় চলছে। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা, অন্যদিকে পরিবর্তনের প্রত্যাশা—দুটি অনুভূতি পাশাপাশি এগোচ্ছে সমাজের ভেতর দিয়ে। এ দেশের জনমানুষ দীর্ঘদিন ধরে স্থিতিশীলতা ও জবাবদিহি–নির্ভর রাষ্ট্র পরিচালনার অভিলাষ পোষণ করে এসেছে। সেই প্রত্যাশার ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা কোন পর্যায়ে আছে—তা নিয়ে মার্কিন পর্যবেক্ষক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) একটি বিস্তৃত জরিপ পরিচালনা করেছে। জরিপের ফলাফল বলছে, বাংলাদেশের গণমানুষ পরিবর্তন দেখতে চায়, চাইছে একটি সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর নির্বাচন, আর সেই পরিবর্তন অভিযাত্রায় তারা অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বকে এখনো ইতিবাচক চোখে দেখছে।
১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত পরিচালিত জরিপে অংশ নেওয়া দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ—প্রায় ৬৯ শতাংশ—বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভালো কাজ করছেন। আরো বিস্তৃতভাবে দেখা যায়, ৭০ শতাংশ উত্তরদাতা পুরো সরকারের কার্যক্রমকে প্রশংসাযোগ্য মনে করছেন। এটি নিছক একটি সংখ্যাতাত্ত্বিক চিত্র নয়, বরং সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মানসিক অবস্থাকে স্পষ্ট করে। বহু পর্যবেক্ষকের মতে, এমন একটি সময়ে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া যখন আস্থা অর্জনের চেয়ে অবিশ্বাস অপসারণই বেশি কঠিন, সেখানে জনগণের এই আস্থা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
আইআরআই-এর এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের সিনিয়র ডিরেক্টর জোহানা কাও জরিপের ফলাফলের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ড. ইউনূস এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর জনগণের আস্থা অটুট আছে। মানুষ একটি জবাবদিহিমূলক সরকার এবং সংস্কারমুখী প্রশাসনের প্রত্যাশা করে, এবং জরিপে সেই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন রয়েছে। এই মন্তব্য বুঝতে হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সামনে আনতে হবে—গত কয়েক দশক ধরে এখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতি কিছু নির্দিষ্ট বৃত্তের মধ্যে আবর্তিত হয়েছে, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচন জনগণের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তাই আজ যখন জনগণের বড় অংশ সংস্কারমুখী রাজনীতির কথা বলছে, তখন সেটি কেবল এক অস্থায়ী প্রত্যাশা নয়, বরং দীর্ঘদিনের সঞ্চিত ক্ষোভ ও আশার মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
জরিপে একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো—আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আশাবাদ। অংশগ্রহণকারীদের ৮০ শতাংশই মনে করেন যে, আসন্ন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। এমন আশাবাদ সাধারণত তখনই জন্ম নেয়, যখন রাজনৈতিক ময়দানে তুলনামূলক সমতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দৃশ্যমান হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বিভিন্ন খাতে সংস্কারের প্রচেষ্টা, প্রশাসনিক পদক্ষেপ, রাজনৈতিক দলের প্রতি সমান আচরণ—এসবই সাধারণ মানুষের আস্থা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ একটি সংবেদনশীল পর্বে রয়েছে, কারণ এই নির্বাচনই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথ। তাই জনগণের এই আশা দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে ইতিবাচক ভূমিকাই রাখতে পারে।
আইআরআই তাদের জরিপকে ‘প্রাক-নির্বাচনী মূল্যায়ন মিশন’ হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং জানিয়েছে, তারা সীমিত পর্যায়ে হলেও আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বিদেশি সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণ অনেকসময় অভ্যন্তরীণ আস্থাকে শক্তিশালী করে, বিশেষত যখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সন্দেহ ও অনাস্থা প্রবল থাকে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা সাধারণত নির্বাচনের নিরপেক্ষতা, সুষ্ঠুভাব, নিরাপত্তা অবস্থা এবং ভোটার অংশগ্রহণ নিয়ে কাজ করে। ফলে আইআরআই-এর উপস্থিতি ভোটারদের কাছে একটি প্রতীকী বার্তা দেয়—সহজ ভাষায়, মানুষ ভাবতে পারে যে নির্বাচনটি আন্তর্জাতিক নজরদারির মধ্যে হচ্ছে, তাই অনিয়মের সুযোগ কম।
জরিপের ফলাফল শুধু সরকারের জনপ্রিয়তা নির্ধারণ করে না; বরং এটি বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের অভ্যন্তরীণ মনস্তত্ত্বেরও প্রতিফলন। গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক পরিসর সংকুচিত হওয়া, অর্থনৈতিক চাপ, বেকারত্ব, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, এবং রাষ্ট্রীয় বহু ইস্যুতে অস্বচ্ছতা—এসব বিষয় জনগণকে ভাবিয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের খোলামেলা পদক্ষেপ, কথোপকথনের পরিবেশ সৃষ্টি এবং প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস তাদের কাছে আস্থা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। অর্থাৎ, মানুষ শুধু বর্তমান পরিস্থিতি নয়, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাও বিবেচনায় আনছে।
জনগণের একটি অংশ অবশ্য এখনো সংশয়ী। তবে জরিপ বলছে—সংশয় থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষ চাইছেন, একটি নতুন পথ উদ্ভাবিত হোক। এমন পরিস্থিতিতে জনগণের মনস্তত্ত্ব সাধারণত দুটি দিকে বিভক্ত হয়—এক, স্থিতিশীলতা চায়; দুই, পরিবর্তন চায়। বাংলাদেশের মানুষ এই দুই চাহিদাকে মিলিয়ে আজ একটি দৃশ্যমান কাঠামো শুনতে চায়—একটি দায়িত্বশীল সরকার, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, প্রতিষ্ঠানগত শক্তি এবং স্বচ্ছ নির্বাচন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা মূলত ওই প্রত্যাশার একটি বহিঃপ্রকাশ।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ইউনূস সরকারের প্রতি জনগণের এই আস্থা তার ব্যক্তিগত সুনাম, আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা এবং নাগরিক আস্থার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। নোবেল বিজয়ী হিসেবে তার পরিচিতি, সামাজিক ব্যবসার ধারণা, দীর্ঘদিনের জনকল্যাণমূলক কাজ—এসবই জনগণের চোখে তার নেতৃত্বকে একটি ভিন্ন ধারায় দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্কে জনগণের প্রত্যাশা দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্বের সততা ও স্বচ্ছতার ওপর ঘুরপাক খাচ্ছে। ড. ইউনূস সেই প্রত্যাশাকে স্পর্শ করতে পেরেছেন—জরিপে স্পষ্টভাবে তার প্রতিফলন দেখা যায়।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি এখন সাংবিধানিক কাঠামো, নির্বাচনী পরিবেশ এবং জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণের ওপর নির্ভর করছে। দেশের মানুষ একটি পরিবর্তনমুখী সময়ের চূড়ান্ত মূল্যায়নে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতি, অন্যদিকে প্রশাসনিক পরিবেশ—দুটিই আগামী নির্বাচনকে ঘিরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি। জরিপ বলছে—বাংলাদেশের মানুষ স্থিরতা, সুশাসন এবং অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায় দেখতে আগ্রহী।
এই আগ্রহ কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নয়, বরং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে। দেশের মানুষের চোখে আজ সবচেয়ে বড় মূল্যবোধ হলো নির্বাচনী প্রতিযোগিতা এবং জবাবদিহি। তারা মনে করছেন—অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে এই প্রতিযোগিতা বাস্তবে রূপ নিতে পারে। জনমতের এই প্রত্যাশাই আগামী নির্বাচনের বাস্তব চিত্র নির্মাণ করবে।
জরিপের ফলাফল যতটা সংখ্যাতত্ত্ব, তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন। একজন রিকশাচালকের আশা, একজন শিক্ষক বা শিল্পীর ভাবনা, একজন ব্যবসায়ীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা—সবকিছু মিলেই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথরেখা তৈরি হচ্ছে। আর এই পথরেখায় অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে মানুষের আস্থা এখনো ইতিবাচক। সেই আস্থা ভবিষ্যতে কতটা টেকসই হয়, তা নির্ভর করবে নির্বাচনের স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা, ন্যায়সংগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং শেষ পর্যন্ত জনগণের অংশগ্রহণের ওপর।
বাংলাদেশের মানুষ আজ একটি পরিষ্কার ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে। তারা আশা করছে—এবার একটি নতুন অধ্যায় শুরু হবে, যেখানে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকবে, ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, এবং গণমানুষের কণ্ঠ হবে দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রধান শক্তি। আইআরআই-এর জরিপ বাংলাদেশের সেই আশাবাদী মুহূর্তটিকেই তুলে ধরেছে—এখানে মানুষ পরিবর্তনে বিশ্বাস রাখে, নেতৃত্বে আস্থা রাখে, এবং ভবিষ্যতের প্রতি দায়িত্বশীল আশা ধরে রেখেছে।
আপনার মতামত জানানঃ