বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘ দশক ধরে যাঁর উপস্থিতি ছিল প্রভাবশালী, যাঁকে কেন্দ্র করে একদিকে আনুগত্যের বলয় তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে গড়ে উঠেছে তীব্র বিরোধিতা—তিনি শেখ হাসিনা। তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর দেশ–বিদেশের রাজনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছে, তা কেবল একটি আদালতের রায় বা একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে ছাড়িয়ে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক সমীকরণকেও নাড়া দিয়েছে। কারণ, শেখ হাসিনা এখন আর শুধুই বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নন; তিনি এক জটিল আঞ্চলিক সম্পর্কের প্রতীক, এক অস্থির রাজনৈতিক সময়ের মুখ, এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েনের কেন্দ্রবিন্দু।
ঢাকার তরুণ শিক্ষার্থী সীমা আখতারের মতো অনেকের কাছে রায়টি এসেছে প্রতীক্ষিত ন্যায়বিচারের মুহূর্ত হিসেবে। গত বছরের শিক্ষার্থী বিক্ষোভে তাঁর কয়েকজন বন্ধু নিহত হয়েছিলেন নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে। সেই দমনের বিরুদ্ধে যখন দেশজুড়ে ক্ষোভ জ্বলে উঠেছিল, তখন অনেকের প্রত্যাশাই ছিল শক্ত হাতে ক্ষমতা ধরে রাখা শেখ হাসিনার পতন। তিনি শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন এবং ভারত আশ্রয় দেয় তাঁকে। সেই থেকেই প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্ক এক নতুন জটিল মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাঁকে ফেরত পাঠানোর দাবি জানানো হলেও ভারত এ ব্যাপারে নীরব অবস্থান ধরে রেখেছে, যা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় তীব্র বিতর্ক তৈরি করেছে।
ভারত কেন তাঁকে ফেরত দিতে চাইছে না—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে ভেসে ওঠে রাজনৈতিক ইতিহাস, নিরাপত্তা–কৌশল, অর্থনৈতিক স্বার্থ, এবং দুই দেশের দীর্ঘকালীন সম্পর্কের জটিল স্তরগুলো। ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী যেমন বলছেন, দিল্লির জন্য কাউকে মৃত্যুদণ্ডের দিকে ঠেলে দেওয়া অকল্পনীয়। একইসঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে ভারত যে ‘ভারতবিরোধী শক্তি’ হিসেবে দেখে, তাও দিল্লির সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে। কারণ, শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়া মানে ভারত যেন নিজের দীর্ঘদিনের মিত্রকে মৃত্যুর মুখে ছুঁড়ে দেওয়া—এমনটাই মনে করছে নয়াদিল্লির নীতিনির্ধারকেরা।
সত্যি বলতে, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবন শুরু থেকে নানা টানাপোড়েনে ভরা। স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হওয়ার কারণে তাঁর ওপর সবসময়ই একটি ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার ছিল। নয়াদিল্লির সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কও বহু পুরোনো। ১৯৭৫ সালে তাঁর পরিবার নিহত হওয়ার পর তিনি ও তাঁর বোন রেহানা ভারতে আশ্রয় পান। দীর্ঘ নির্বাসনজীবন কাটানোর পর যেদিন তিনি বাংলাদেশে ফেরেন, সেদিন থেকেই রাজনীতিতে তাঁর উত্থান শুরু। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ক্ষমতার বাইরে থাকলেও ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি টানা ১৫ বছর রাজত্ব করেন। এই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত উন্নতি করে, আন্তর্জাতিকভাবে দেশ নতুন মর্যাদা লাভ করে। কিন্তু সমানতালে বাড়তে থাকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ, বিরোধীদের ওপর দমনপীড়ন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের সংখ্যা। তাঁর সমর্থকের কাছে এগুলো ছিল ‘কঠোর রাষ্ট্র পরিচালনা’; তবে বিরোধীদের কাছে এগুলো ছিল ভয়ংকর দমননীতি।
২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন হতে হতে তাঁর শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে অসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটায়। শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি উদাসীনতা, আন্দোলনকারীদের ওপর দমন, এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দেয় ক্ষমতা থেকে, এবং তিনি আশ্রয় নেন সেই দেশে—ভারতে—যেখান থেকে তাঁর রাজনৈতিক যাত্রার দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়েছিল বহু বছর আগে।
কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশের নতুন সরকার, যার শীর্ষে আছেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, ভারতের প্রতি পূর্বের নরম অবস্থান থেকে সরে এসে কঠোর কূটনৈতিক ভাষায় বলেছেন, প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানো ভারতের দায়িত্ব। কিন্তু ভারত বলছে, চুক্তিতে ‘রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের’ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে এবং এই ধারাটি কার্যকর। ভারতের নজরে এটি মূলত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিশোধের ইস্যু, এবং দিল্লি চায় না তারা এ ধরনের কোনো প্রতিশোধমূলক প্রক্রিয়ার সহায়ক হোক।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ভারতবিরোধী অবস্থানও দিল্লির মনোভাবকে কঠোর করেছে। দিল্লি মনে করছে, হাসিনাকে ফেরত দিলে বর্তমান সরকার এবং দেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো ভারতকে ‘শত্রু’ হিসেবে প্রতিস্থাপন করতে আরও সুবিধা পাবে। অন্যদিকে কাশ্মীর থেকে শুরু করে সীমান্ত সুরক্ষা—নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সহযোগিতা দীর্ঘদিনের। ফলে এই মুহূর্তে নয়াদিল্লি এমন কোনো ঝুঁকি নিতে চাইবে না যা ভবিষ্যৎ সম্পর্ককে আরও অবনতির দিকে ঠেলে দেবে।
এদিকে বাংলাদেশের নতুন সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে, এটিও ভারতকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতে পাকিস্তান–ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতা দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশের ওপর প্রভাব হারাতে চাইবে না দিল্লি, বিশেষ করে তখন যখন চীনও এখানে ক্রমশ প্রভাব বাড়িয়ে তুলছে। তাই শেখ হাসিনার উপস্থিতি দিল্লির কাছে ‘বাধা’ নয়; বরং কিছুটা ‘কৌশলগত সম্পদ’। যদিও তাঁর উপস্থিতি ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে একটি স্থায়ী কাঁটা হয়ে থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
অন্যদিকে বাংলাদেশের ভেতরেও পরিস্থিতি স্থিতিশীল নয়। দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বিভক্ত, জনমনে বিরোধ ও ক্ষোভের রেশ এখনো তীব্র। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর বিজয়-উল্লাস দেখা গেলেও, উল্লেখযোগ্য অংশের রাজনৈতিক জনসমর্থন এখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংযুক্ত। এটি দিল্লি ভালো করেই জানে এবং সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁরা বুঝে এসেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় পরিবার–কেন্দ্রিক দলগুলো চিরদিন বিলুপ্ত হয় না। তাঁরা দুর্বল হয়, কিন্তু কোনো না কোনোভাবে ফিরে আসে।
তাই ভারত ভবিষ্যৎ হিসেবেও বুঝে নিচ্ছে যে আওয়ামী লীগ পুরোপুরি রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে হারিয়ে যাবে না। এই দলে যে-কোনো নতুন নেতৃত্ব আবার দিল্লির সঙ্গে নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। সেটি কেবল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু শেখ হাসিনাকে যদি ভারত বাংলাদেশের হাতে তুলে দেয়, তবে সেই সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। ভারত সেই ঝুঁকি নিতে চাইছে না।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনো ভারতবিরোধী মনোভাব বেশ প্রবল, বিশেষ করে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, বাণিজ্য বৈষম্য, পানি বণ্টন এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়ে অসন্তোষ বহুদিনের। ফলে শেখ হাসিনার প্রসঙ্গটি এখন একটি দুই দেশের জন–অসন্তোষের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের সরকার চাইছে রায় বাস্তবায়ন করে নিজেদের রাজনৈতিক বৈধতা বাড়াতে, আর ভারত চাইছে তার দীর্ঘদিনের কৌশলগত সম্পর্ক ভেঙে না দিয়ে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে।
এই টানাপোড়েনের মাঝেই উঠে আসে আরেকটি প্রশ্ন—ভারত কি বাংলাদেশকে পুরোপুরি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় ছেড়ে দেবে? বিশেষজ্ঞদের মতে, সেটি সম্ভব নয়। ভারত বাংলাদেশের দরজা বন্ধ করতে পারে না। কারণ, ভূগোলগত ঘনিষ্ঠতা, বিস্তীর্ণ সীমান্ত, বাণিজ্যিক স্বার্থ, এবং নিরাপত্তা–সংক্রান্ত বাস্তবতা দুই দেশকে বাধ্য করেছে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল থাকতে। তাই যতই সম্পর্ক ‘শীতল’ হোক, সম্পর্ক ছিন্ন হবে না।
ভবিষ্যতে কি হতে পারে? সবচেয়ে সম্ভাব্য চিত্রটি হলো, শেখ হাসিনা ভারতে রয়ে যাবেন, হয়তো অনির্দিষ্টকালের জন্য। তাঁকে ফেরত পাঠানোর মতো কূটনৈতিক ঝুঁকি ভারত নেবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশের সরকার এই ইস্যুকে বারবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলবে এবং আরও চাপ সৃষ্টি করবে। অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক টানাপোড়েন বাড়বে, কিন্তু চূড়ান্ত রূপ নেবে না। কারণ দুই দেশের পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীলতা এত বেশি যে সম্পর্ক পুরোপুরি ভাঙা সম্ভব নয়।
সব মিলিয়ে শেখ হাসিনা এখন এক প্রতীক—ক্ষমতা, পতন, ভূরাজনীতি, কৌশল আর আস্থা–অনাস্থার। তিনি যে দেশে জন্মেছেন, সে দেশে এখন তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যুদণ্ডের রায়। আর যে দেশে তিনি বারবার আশ্রয় পেয়েছেন, সে দেশ তাঁকে ফেরত পাঠানোর রাস্তায় হেঁটেছে মাত্র একবারও না। এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতা স্পষ্ট—এই অঞ্চলে কোনো সিদ্ধান্ত কখনোই শুধুই অভ্যন্তরীণ থাকে না; প্রতিটি পদক্ষেপের প্রতিধ্বনি শোনা যায় সীমান্ত পেরিয়ে আরেক দেশে।
এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার ভবিষ্যৎ যাই হোক, নিশ্চিতভাবে বলা যায়—তাঁকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতি আর ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্ক বহু বছর ধরে উত্তাপ, বিতর্ক এবং পরিবর্তনের উৎস হয়ে থাকবে। এবং এই ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন জটিল অধ্যায় হিসেবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আপনার মতামত জানানঃ