
নির্বাচন না হলে বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা শুধুই আবেগের কথা নয়, বাস্তব রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার ভেতরেও এর শক্ত ভিত্তি আছে। একটি রাষ্ট্রকে ব্যর্থ বলা হয় তখনই, যখন সে তার নাগরিকদের নিরাপত্তা, ন্যূনতম সেবা, আইনের শাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় এবং রাষ্ট্রের বৈধতা জনগণের চোখে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ এখন যে ক্রান্তিকালের মুখোমুখি, সেখানে নির্বাচনী প্রক্রিয়া ভেঙে গেলে এই সব সূচকেই ধস নামার ঝুঁকি তৈরি হবে, যা আমাদের ধীরে ধীরে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
একটি রাষ্ট্র ব্যর্থ কি না তা নির্ধারণের জন্য রাজনৈতিক তত্ত্বে কয়েকটি দৃষ্টিকোণ গুরুত্ব পায়—রাষ্ট্রের ভূখণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ, আইন–শৃঙ্খলা রক্ষা, কর আদায় ও জনসেবা দেওয়ার ক্ষমতা, এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতা। ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলোতে দেখা যায়, সরকার শুধু দুর্বল নয়, বরং সমাজের বড় অংশের জন্য কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে; বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী, মাফিয়া বা বিদেশি শক্তি বাস্তব ক্ষমতার অংশীদার হয়ে ওঠে। নির্বাচন নামের প্রক্রিয়াটা সেখানে হয়তো কাগজে–কলমে থাকে, কিন্তু অংশগ্রহণমূলক, প্রতিযোগিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুপস্থিত থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি নির্বাচন পুরোপুরি স্থগিত হয়, কিংবা এমন এক দীর্ঘ অ-নির্বাচনী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় যা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, তাহলে এই ক্লাসিক লক্ষণগুলো দ্রুতই দৃশ্যমান হওয়ার আশঙ্কা আছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, ক্ষমতার প্রশ্নে সমঝোতার চেয়ে মুখোমুখি সংঘাতই এখানে বেশি উপস্থিত। সামরিক শাসন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, কলেবর বদলানো নির্বাচন কমিশন—সবকিছুর পেছনে কেন্দ্রীয় প্রশ্ন ছিল, কে নির্বাচন আয়োজন করবে এবং জনগণ কি সেই প্রক্রিয়ায় আস্থা রাখবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ, গুম–খুনের ইস্যু এবং একতরফা নির্বাচনের সমালোচনা দেশীয়–আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ছাত্র–জনতার আন্দোলন দিয়ে দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন নেতৃত্বকে অপসারণ, তারপর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার, দল নিষিদ্ধকরণ, আবার আসন্ন নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে নতুন রাজনৈতিক টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
একটা পর্যায়ে যদি নির্বাচনই না হয়, অথবা অনেক বছর ধরে এমন এক ব্যবস্থায় দেশ চলে যেখানে জনগণের ভোটাধিকার স্থগিত—সেটা কার্যত রাষ্ট্রের বৈধতা ছিন্নভিন্ন করে দেয়। নির্বাচনের আগে–পরে সহিংসতা, দমন–পীড়ন বা অনিয়ম থাকলেও অন্তত এক ধরনের আনুষ্ঠানিক বৈধতার আলগা সেতু থেকে যায়; কিন্তু সম্পূর্ণ নির্বাচনহীন শাসন সেই সেতুটাই ভেঙে ফেলে। রাষ্ট্র তখন আইনগতভাবে শক্তিশালী হলেও নৈতিকভাবে দুর্বল; জনগণের বড় অংশ তাকে নিজেদের শাসনব্যবস্থা হিসেবে মানতে চায় না। এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে অস্বীকৃতি, প্রতিরোধ, এমনকি সশস্ত্র প্রতিরোধও গড়ে উঠতে পারে, যেমনটা আফগানিস্তান, সোমালিয়া বা সিরিয়ার মতো দেশে দেখা গেছে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ, রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত দেশে এমন পরিস্থিতি ভয়াবহ মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি কিছু সময় ধরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণের চাপ ও রফতানি বাজারের অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা যখন দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে যায়, পুঁজি পাচার বাড়ে, মেধাপাচার ত্বরান্বিত হয় এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোও শর্ত কঠোর করে। যদি নির্বাচন না হয় এবং ক্ষমতার প্রশ্ন অনির্ণীত থেকে যায়, তাহলে সরকারি নীতি ধারাবাহিকতা হারাবে, বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন রাজনৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে, উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো প্রকল্পগুলোও দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। অর্থনীতিতে এই অস্থিতিশীলতা রাষ্ট্রের সেবা–দানের ক্ষমতাকে দুর্বল করে, যা ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে এগোনোর অন্যতম ধাপ হিসেবে বিবেচিত।
আইনের শাসন ও মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ব্যর্থতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। গত এক দশকে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, বিরোধী মত দমনের অভিযোগ বারবার উঠেছে; আবার অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তুলছে ভিন্ন পক্ষ। নির্বাচন না হলে বা অন্তত বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন না থাকলে এই ধরনের দমন–পীড়ন আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারে; কারণ তখন ক্ষমতাসীনদের ওপর জবাবদিহির চাপ কমে যায়, আর বিরোধীদের সামনে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক অংশগ্রহণের পথও সংকুচিত হয়। ফলাফল হিসেবে রাজনৈতিক সহিংসতা, প্রতিশোধপরায়ণতা এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর আস্থাহীনতা তীব্রতর হয়—যা ব্যর্থ রাষ্ট্রের লক্ষণগুলোরই অংশ।
রাষ্ট্রব্যবস্থার টেকসই স্থিতিশীলতা নির্ভর করে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি ও অংশগ্রহণমূলক শাসনের ওপর। বাংলাদেশের বর্তমান সংকটে সব পক্ষ থেকেই “অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের” কথা শোনা যাচ্ছে, বিশেষ করে ২০২৬ সালের সম্ভাব্য নির্বাচনের প্রসঙ্গে। যদি এই নির্বাচনী প্রক্রিয়াও ভেস্তে যায় বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশা, শ্রেণি–গোষ্ঠীর মধ্যে যে আড়ষ্ট আস্থা আছে তাও ভেঙে পড়বে। তরুণ প্রজন্ম, যারা সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রধান শক্তি, তারা যদি রাষ্ট্র থেকে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের আশা হারিয়ে ফেলে, তাহলে তাদের একাংশ সহিংসতা, উগ্রবাদ বা প্রবাস–নির্ভর ফাঁকফোকর খোঁজার পথে ঝুঁকে পড়তে পারে। এতে সমাজে গোষ্ঠীগত সংঘাত, ধর্মীয় বা জাতিগত উত্তেজনা বাড়ার সুযোগ তৈরি হবে—যা অনেক ব্যর্থ রাষ্ট্রের জন্মকথায় দেখা যায়।
একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও বড় আঘাত পাবে। বর্তমানে মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, দল নিষিদ্ধকরণ, প্রবাসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিচার—এসব বিষয় নিয়েই বেশি আলোচনা চলছে। নির্বাচন না হলে বা ফরমাল গণতান্ত্রিক কাঠামো পুরোপুরি স্থগিত থাকলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশকে “ফ্র্যাজাইল” বা “হাই রিস্ক” ক্যাটাগরিতে দেখতে শুরু করবে। এর পরিণতিতে বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস, নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক চাপ কিংবা নিরাপত্তা–সংকটের অজুহাতে বাইরের শক্তির অতিরিক্ত হস্তক্ষেপও দেখা দিতে পারে। এগুলো মিলিয়েই একসময় রাষ্ট্রের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে—যা ব্যর্থ রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
তবে এ কথাও ঠিক যে, “ব্যর্থ রাষ্ট্র” শব্দটা নিয়ে আন্তর্জাতিক গবেষণায় অনেক বিতর্ক আছে। অনেকেই বলেন, এই লেবেলটা খুব সহজেই ব্যবহার করা হয় এবং বহু ভিন্নধর্মী সমস্যাকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। বাংলাদেশকে তাই হালকা হাতে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে দেওয়া যেমন ঠিক নয়, তেমনি “আমাদের কিছুই হবে না”—এই আত্মতুষ্টিও ভয়াবহ ভুল। রাষ্ট্রকে ব্যর্থতার দিকে নিয়ে যায় একদিনে ঘটা কোনো ঘটনা নয়; বরং বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক সমঝোতার অভাব, দুর্নীতি, বৈষম্য, আইনের শাসনের ঘাটতি আর জবাবদিহিহীন শাসন মিলে একটা ক্রমাগত অবক্ষয় তৈরি করে। নির্বাচন না হওয়া বা নির্বাচনকে অকার্যকর করে দেওয়া সেই অবক্ষয়ের গতিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে—যেন শেষ ধাক্কাটা দিয়ে দেওয়া।
সবশেষে বলা যায়, নির্বাচন কোনো ম্যাজিক নয় যে হলেই সব সমস্যা উধাও হয়ে যাবে, আর না হলেই কাল সকালে বাংলাদেশ সোমালিয়া হয়ে যাবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচন হলো রাজনৈতিক বৈধতা, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা–হস্তান্তর ও সংঘাত–পরিচালনার ন্যূনতম প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যম। বাংলাদেশ যদি এই মাধ্যমটাকেই পরিত্যাগ করে, বা দীর্ঘমেয়াদি অ-নির্বাচনী ব্যবস্থায় ঢুকে যায়, তাহলে রাষ্ট্রের ওপর জনগণের আস্থা ভেঙে পড়বে, অর্থনীতি ও সমাজের কাঠামো নড়বড়ে হয়ে যাবে, এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশটিকে ক্রমশ দুর্বল ও অস্থির রাষ্ট্র হিসেবে দেখা হবে। সেই পথের শেষ প্রান্তে অপেক্ষা করে থাকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের অন্ধকার পরিস্থিতি। তাই বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে হলে, সব পক্ষের স্বার্থ–সংঘাতের ঊর্ধ্বে উঠে অন্তত একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা ছাড়া আর কোনো বাস্তব বিকল্প নেই।
আপনার মতামত জানানঃ