
দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির মেরুদণ্ড আজও তৈরি পোশাক খাত। গ্রাম থেকে শহরে উঠে আসা লক্ষ লক্ষ তরুণ–তরুণীর জীবিকা, পরিবারের ভরণপোষণ, সন্তানদের পড়াশোনা—সবকিছুই অনেক ক্ষেত্রে নির্ভর করে একটি কারখানা, একটি অর্ডার, একটি রপ্তানি চালানের ওপর। অথচ ঠিক এই খাতটিই এখন টানা তিন মাস ধরে চাপের মুখে। একদিকে নতুন অর্ডার কমেছে, অন্যদিকে অল্পদিনের ব্যবধানে কয়েকশ’ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, শুল্কনীতি, দেশীয় রাজনৈতিক অস্থিরতা আর ক্রেতাদের আস্থাহীনতা একসূত্রে গাঁথা হয়ে যেন তৈরি করেছে এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার দেয়াল, যার সামনে দাঁড়িয়ে শ্রমিক, উদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদ—সবাই উদ্বিগ্ন, ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত।
রপ্তানি আদেশের বাস্তব চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন বা ইউডি’র তথ্যের দিকে তাকালে। যে ইউডি সনদ না পেলে কোনো কারখানা রপ্তানির জন্য কাঁচামালও আমদানি করতে পারে না, সেই ইউডিতেই ধরা পড়েছে অর্ডার কমে যাওয়ার নির্মম হিসাব। সেপ্টেম্বরে যেখানে ২৪৫ কোটি ডলারের অর্ডার এসেছিল, ঠিক তার পরের মাস অক্টোবরে অর্ডার নেমে এসেছে ২২০ কোটি ডলারে। এক মাসে ৩৯ কোটি ডলারের অর্ডার উধাও—এই পতন শুধু সংখ্যার খেলা নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার শ্রমিকের ওভারটাইম বন্ধ হওয়া, বোনাস অনিশ্চিত হয়ে পড়া, এমনকি চাকরি হারানোর আতঙ্ক। ঢাকা অঞ্চলের কারখানাগুলোর অর্ডার কমেছে ১৫ শতাংশ, চট্টগ্রামে কমেছে ২৬ শতাংশ—সংকট যে সীমিত কোনো অঞ্চলের নয়, বরং সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চলজুড়েই তা ছড়িয়ে পড়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই অর্ডার কমার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক। বিশ্ববাজারে যেখানে প্রতিযোগী দেশগুলো বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্য সুবিধা কাজে লাগিয়ে কম খরচে পণ্য পাঠাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বাড়তি শুল্ক আরোপ পুরো সমীকরণটাই পাল্টে দিয়েছে। ক্রেতারা দেখছে, একদিকে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আনলে তাদের বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে চীনসহ কিছু দেশ ইইউ ও অন্য বাজারে কম দামে পণ্য দিতে পারছে। ফলে বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো হিসাব করে দেখছে, কোথা থেকে কম দামে, কম ঝুঁকিতে এবং রাজনৈতিকভাবে তুলনামূলক স্থিতিশীল দেশ থেকে পণ্য আনা যায়। অনেকেই তাই নতুন অর্ডার না দিয়ে অপেক্ষা করছে, বাজার পরিস্থিতি আরো কেমন হয়, তা দেখার জন্য। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের একটি শীর্ষ ক্রেতা প্রতিষ্ঠান সাম্প্রতিক সময়ে সরাসরি তাদের অর্ডার বাতিল করেছে—এটা শুধুমাত্র একটি বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং একটি অ্যালার্মিং সিগনাল, যা ভবিষ্যতের বড় ঝুঁকির দিকেই ইঙ্গিত করে।
কিন্তু শুধু শুল্কই নয়, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলার অনিশ্চয়তা। বড় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো যখন কোনো দেশে বিনিয়োগ বা অর্ডার দেয়, তখন তারা শুধু দামের হিসাব করে না, তারা দীর্ঘমেয়াদে সরবরাহের স্থিতিশীলতা, শ্রমিক-নিয়োগ সম্পর্ক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি—সবকিছুই বিবেচনায় আনে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে টানা রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল-অবরোধ, সড়কে সহিংসতা, জ্বালাও-পোড়াও, কারখানার সামনে অশান্ত পরিবেশ—এসবই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, পৌঁছেছে ক্রেতাদের টেবিলে। ফলে বাংলাদেশকে অনেক ক্রেতা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। ক্রেতারা ভাবছেন, হঠাৎ যদি বন্দর দুই-তিন দিন বন্ধ থাকে, সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে, তবে সময়মতো পণ্য ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব হবে কি না। এইসব অনিশ্চয়তাকে সামনে রেখে তারা অর্ডার দিতে দ্বিধা করছে, আর এভাবেই ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে বাংলাদেশের রপ্তানি।
এই অনিশ্চয়তার সবচেয়ে বড় আঘাত লেগেছে কারখানা মালিকদের পর কার ওপর? শ্রমিকদের ওপর। বিজিএমইএ’র তথ্য বলছে, গত ১৪ মাসে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এবং নরসিংদী—এই পাঁচ অঞ্চলে বন্ধ হয়ে গেছে ৩৫৩টি কারখানা। এর মানে, এক লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ জন শ্রমিক একসঙ্গে তাদের আয়ের উৎস হারিয়েছেন। শুধু সংখ্যাটি উচ্চারণ করলেই হয়তো বোঝা যায় না এর গভীরতা। বাস্তবে এর অর্থ হচ্ছে—হঠাৎ করেই বিপুল সংখ্যক পরিবারে বাজার খরচ কমে গেছে, সন্তানদের স্কুলের ফি দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে, গ্রামে বাড়ির লোকজনের জন্য টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে গেছে। সাভার অঞ্চলে ২১৪টি কারখানা বন্ধ হওয়ার খবর যেন এই সংকটের প্রতীকী চিত্র—তার মধ্যে ১২২টি স্থায়ীভাবে, ৯২টি সাময়িকভাবে বন্ধ। শুধু সাভারেই প্রায় ৩১ হাজার শ্রমিক আজ বেকার। কিছু বড় কারখানার নাম—ছেইন অ্যাপারেলস, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন, সাফওয়ান আউটারওয়্যার—বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে দেশের পোশাক খাতে বহুল প্রচলিত ও পরিচিত কয়েকটি নাম এক ঝটকায় বাজার থেকে সরে যাওয়া।
গাজীপুরের অবস্থা আরো করুণ। এখানে ৭২টি কারখানা বন্ধ হয়ে কাজ হারিয়েছেন ৭৩ হাজারেরও বেশি শ্রমিক। বেক্সিমকো গ্রুপের ১৩টি পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়াকে অনেকেই বড় ধাক্কা হিসেবে দেখছেন। বেক্সিমকোর মতো প্রতিষ্ঠিত গ্রুপ যখন ব্যবসায়িকভাবে টিকে থাকতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দেয়, তখন ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ভেতরে যে ধরনের ভীতি তৈরি হয়, তা সহজেই অনুমেয়। তারা কেউ কেউ এখন ন্যূনতম মুনাফা বা ব্রেক-ইভেন পয়েন্টে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন, কেউ আবার ব্যাংক ঋণের চাপ, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল, শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর চাপের সঙ্গে আর পারছেন না বলে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন, কারখানার একটি লাইন বন্ধ রেখেছেন, কিংবা পুরো কারখানাই বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তায় আছেন।
শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দও এই সংকটকে একধরনের বৈপরীত্য হিসেবে দেখছেন। বাংলাদেশের সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটির প্রতিষ্ঠাতা কল্পনা আখতার স্মরণ করিয়ে দেন, জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান প্রক্রিয়ায় শ্রমিকরাও একধরনের আশা নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন বৈষম্য কমবে, জীবনমান কিছুটা উন্নত হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরও তাদের জীবনে স্থায়ী কোনো নিরাপত্তা আসেনি, বরং অনেকেই কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে যাচ্ছেন। অর্থনীতি যখন চাপের মুখে, তখন বড় বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র উদ্যোগ—সবখানেই সাশ্রয়ের নামে প্রথম আঘাতটা আসে শ্রমিকের চাকরির ওপর, তাদের ওভারটাইমের ওপর, তাদের সামাজিক নিরাপত্তার ওপর। ফলে শিল্পে অস্থিরতা রাজনৈতিক অস্থিরতাকেও আবার উসকে দিতে পারে—এক ধরনের দুষ্টচক্র তৈরি হয়, যার থেকে বেরিয়ে আসা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, টানা তিন মাস ধরে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমছে। দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশই আসে এই খাত থেকে। এই বিশাল পোর্টফোলিওর ভেতরেই যদি তিন মাস ধরে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি চলে, সেটা শুধু শিল্প খাত নয়, পুরো অর্থনীতির জন্যই এক বড় সতর্কবার্তা। অক্টোবরে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ৮.৩৯ শতাংশ; রপ্তানি হয়েছে ৩০২ কোটি ডলারের, যেখানে আগের বছরের একই মাসে ছিল ৩৩০ কোটি ডলার। এক মাসে ২৮ কোটি ডলারের রপ্তানি কমে যাওয়া মানে, সেই পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশের রিজার্ভেও আসেনি, কারখানার হিসাবের খাতায় ঢোকেনি, শ্রমিকদের বেতন-বোনাস হিসেবে নগদে পরিণত হয়নি। সেপ্টেম্বরে রপ্তানি নেমেছে ২৮৪ কোটি ডলারে, যেখানে আগে ছিল ৩০১ কোটি ডলার। আগস্টে কমেছে ৪.৭৫ শতাংশ। এই ধারাবাহিকতা দেখেই সংশ্লিষ্টরা বলছেন—এটা সাময়িক ওঠানামা নয়, বরং একটি কাঠামোগত সংকটের লক্ষণ।
ওভেন ও নিট—এই দুই ধরনের পোশাকেই পতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যদিও নিট সেগমেন্টে পতন কিছুটা বেশি। অক্টোবরে ওভেন পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫.৩৩ শতাংশ, নিট পোশাক ১০.৭৬ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ওভেন পোশাক রপ্তানি কমার হার ছিল ৫.৫৪ শতাংশ, নিটে ৫.৭৫ শতাংশ। এর আগের মাস আগস্টে ওভেনে পতন ২.৬৫ এবং নিটে ৬.৩৪ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান বলছে, বাজারে যে ধরনের পোশাকেরই চাহিদা থাকুক না কেন, সরবরাহের স্থিতিশীলতা ও আস্থার অভাবের কারণে ক্রেতারা বাংলাদেশকে কিছুটা ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ অবস্থায় রেখেছেন। হয়তো তারা সাময়িকভাবে অর্ডার অন্য দেশে সরিয়ে নিচ্ছেন, আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কিছু অংশ ফিরিয়ে আনবেন—কিন্তু এই ‘সাময়িক’ সময়টুকুই কারখানা ও শ্রমিকদের জন্য সবচেয়ে কষ্টকর পর্ব হয়ে ওঠে।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান স্পষ্ট করেই বলেছেন, আন্তর্জাতিক ক্রেতারা এখন সরবরাহ স্থিতিশীলতা ও আস্থাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। গত এক বছরে ২৫৮টি কারখানা উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে—এটি শুধু খাতটির ভেতরের সমস্যার ইঙ্গিত নয়, বরং সরকারের সামগ্রিক নীতির এক ধরনের ব্যর্থতারও প্রতিফলন। কারখানাগুলো ক্রমবর্ধমান ব্যয়, বিদ্যুৎসংকট, নতুন মজুরি কাঠামোর চাপ, এবং একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থির চাহিদার দ্বৈত আঘাতে টিকে থাকতে পারছে না। অনেকেই অর্ডার পেলেও উৎপাদন খরচের সঙ্গে দামের ভারসাম্য রাখতে পারছেন না; ডলার সংকট, ব্যাংক সুদের হার, আমদানি ব্যয়—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। যদিও একই সময় নতুন ১৬৬টি কারখানা চালুও হয়েছে, কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যে এভাবে একদিকে কারখানা বন্ধ, অন্যদিকে কিছু নতুন কারখানা চালু—এটি এক ধরনের অস্থিরতার ইঙ্গিত, যেখানে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার চেয়ে স্বল্পমেয়াদি ঝুঁকি বেশি।
বড় ক্রেতাদের একটি সুস্পষ্ট প্রবণতা হলো—যখন কোনো দেশে ধারাবাহিকভাবে কারখানা বন্ধ হতে থাকে, শ্রমিক অসন্তোষ বাড়তে থাকে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির থাকে, তখন তারা ধীরে ধীরে বিকল্প দেশ খুঁজতে শুরু করেন। মাহমুদ হাসান খান সতর্ক করে দিয়েছেন, যদি এভাবে কারখানা বন্ধের ধারা চলতেই থাকে, তবে ক্রেতারা ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে অর্ডার সরিয়ে নিতে পারে। ইতিমধ্যেই এসব দেশ বিপুল পরিমাণে অবকাঠামো উন্নয়ন, দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে বিনিয়োগ করেছে, বন্দর ও লজিস্টিক ব্যবস্থাকে আধুনিক করেছে, এবং রাজনৈতিকভাবে নিজেদের তুলনামূলক স্থিতিশীল দেশ হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছে। ফলে বাংলাদেশের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে তারা বহুমুখী উৎস থেকে পোশাক কিনতে আগ্রহী হচ্ছে। একবার অর্ডার সরে গেলে অল্প সময়ে তা ফিরিয়ে আনা কখনোই সহজ হয় না; নতুন করে আস্থা অর্জন করতে হয়, আবারও প্রমাণ করতে হয়—আমরাই সেরা, আমরাই সময়মতো, মানসম্মত পণ্য দিতে পারি।
তবে সবকিছু শুধু নেতিবাচক নয়। বিগত এক দশকে ইইউর ২৭ দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৫৮ শতাংশ বেড়েছে—অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের তথ্য তাই বলছে। একই সময়ে ইইউতে চীনের পোশাক রপ্তানি কমেছে ৪ শতাংশ। আবার ইউরোস্ট্যাটের সাম্প্রতিক হিসাব দেখাচ্ছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ইইউতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৩ শতাংশ; পরিমাণ ১৩.৪৮ বিলিয়ন ইউরো। যদিও একই সময়ে চীনের রপ্তানি বেড়েছে ১৭ শতাংশের বেশি, তবে প্রতিযোগিতার এই ময়দানে বাংলাদেশ যে একেবারে পিছিয়ে পড়েনি, বরং এখনো ভালোই লড়ছে, তা বোঝা যায়। অর্থাৎ, সঠিক নীতি সহায়তা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং শ্রমিক–উদ্যোক্তা সম্পর্ক উন্নত করতে পারলে আবারও এই খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারে—এর বাস্তব ভিত্তি আছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্ক আরোপের ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্যেও এক ধরনের পুনর্গঠন চলছে। বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেছেন, বিভিন্ন দেশের ওপর অস্বাভাবিক হারে শুল্ক আরোপের কারণে বাণিজ্য প্রবাহের দিক পরিবর্তন হচ্ছে; ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে এখনো আলোচনাও চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাড়তি শুল্কের প্রভাবে সেখানে পোশাকের দাম বেড়ে গেছে, ভোক্তারা চাপের মুখে পড়েছেন, একই সঙ্গে ব্র্যান্ডগুলোও ব্যয়ের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এই বিশৃঙ্খলার ভেতরেই বাংলাদেশকে এমনভাবে নিজের অবস্থান তৈরি করতে হবে, যাতে একদিকে ক্রেতারা বুঝতে পারেন—আমরা নির্ভরযোগ্য, অন্যদিকে শ্রমিকরাও বুঝতে পারেন—এই খাতেই তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ। কিন্তু তা করার জন্য প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, অর্থনৈতিক কূটনীতি, এবং সর্বোপরি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
সবশেষে বলা যায়, তৈরি পোশাক খাতের বর্তমান সংকট কোনো একক ঘটনার ফল নয়; বরং এটি বহু বছরের জমে থাকা কাঠামোগত দুর্বলতা, নীতি-অসংগতির প্রতিফলন, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব। কারখানা বন্ধ হওয়া, অর্ডার কমে যাওয়া, শ্রমিক বেকার হওয়া—এসব ঘটনাকে যদি শুধু তাৎক্ষণিক সমস্যা হিসেবে দেখা হয়, তবে সমাধানের বদলে সংকট আরও গভীর হবে। এই খাতের ভবিষ্যৎ বাঁচাতে হলে একইসঙ্গে শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি ও নিরাপত্তা, উদ্যোক্তার ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ, এবং ক্রেতার আস্থা—এই তিনকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। রাষ্ট্রকে পরিষ্কার বার্তা দিতে হবে—বাংলাদেশ এখনও তৈরি পোশাক রপ্তানির নির্ভরযোগ্য গন্তব্য, এখানে আইনের শাসন আছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আছে, শ্রমিকের অধিকার ও ক্রেতার স্বার্থ—উভয়ই রক্ষা করার আন্তরিকতা আছে। নাহলে, যে খাত ৪০ বছর ধরে দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে, বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, সেই খাতই একদিন অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার প্রতীকে পরিণত হবে—যার অভিঘাত যাবে গ্রাম থেকে শহর, কারখানা থেকে পরিবার—সবখানে।
আপনার মতামত জানানঃ