একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা দল সম্প্রতি এমন একটি আবিষ্কার করেছে যা আমাদের ধারণা পাল্টে দিচ্ছে—সীসার সংস্পর্শ কেবল আধুনিক শিল্পযুগের ফল নয়। গবেষকরা বলছেন, আমাদের মানব পূর্বপুরুষরা প্রায় দুই মিলিয়ন বছর ধরে সময় সময়ে এই বিষাক্ত ধাতুর সংস্পর্শে ছিলেন, এবং সেই সংস্পর্শ মানব মস্তিষ্ক, আচরণ, এমনকি ভাষার বিকাশকেও প্রভাবিত করেছে।
এই গবেষণাটি Science Advances জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা যায়, সীসার প্রভাব মানুষের তুলনায় নিয়ান্ডারথালদের জন্য আরও ক্ষতিকর ছিল। অর্থাৎ, সীসা হয়তো পরোক্ষভাবে নিয়ান্ডারথালদের বিলুপ্তি এবং আধুনিক মানুষের টিকে থাকার পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
অস্ট্রেলিয়ার সাদার্ন ক্রস ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্রের মাউন্ট সিনাই হাসপাতাল এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান দিয়েগোর গবেষকরা যৌথভাবে এই কাজটি করেন। তাঁরা ফসিল দাঁতের রাসায়নিক বিশ্লেষণ, কৃত্রিম মস্তিষ্কের (ব্রেন অর্গানয়েড) পরীক্ষা এবং জিনগত তুলনা ব্যবহার করে সীসার প্রভাবের ইতিহাস উন্মোচন করেছেন।
বিজ্ঞানীরা আগে ভাবতেন, সীসা দূষণ শুরু হয় খনি, ধাতু গলানো, এবং সীসাযুক্ত জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে আধুনিক যুগে। কিন্তু গবেষকরা ৫১টি প্রাচীন দাঁতের ফসিল বিশ্লেষণ করে দেখতে পান যে, প্রাচীন মানব ও বানর প্রজাতির দাঁতে নিয়মিত সীসার উপস্থিতি ছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল Australopithecus africanus, Paranthropus robustus, প্রাথমিক Homo প্রজাতি, নিয়ান্ডারথাল এবং আধুনিক Homo sapiens। দাঁতের এনামেলে পাওয়া “lead bands” প্রমাণ করে, শৈশব থেকেই তারা সময় সময়ে সীসার সংস্পর্শে আসত—যেমন দূষিত পানি, মাটি, আগ্নেয়গিরির ধোঁয়া, বা শরীরের হাড়ে জমে থাকা সীসা যা পরে অসুস্থতা বা চাপের সময় মুক্ত হতো।
গবেষণা দলের প্রধান অধ্যাপক রেনো জোয়ানেস-বোয়াউ বলেন, “সীসা দূষণ কেবল আধুনিক শিল্পযুগের বিষয় নয়, বরং এটি আমাদের বিবর্তনীয় ইতিহাসেরই একটি অংশ।” তিনি আরও যোগ করেন, “এর মানে হলো, আমাদের পূর্বপুরুষদের মস্তিষ্ক এমন এক পরিবেশে বিকশিত হয়েছে, যেখানে সীসা নিয়মিত প্রভাব ফেলত, যা তাদের সামাজিক আচরণ ও চিন্তাশক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে।”
ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানীরা মানব মস্তিষ্কের ক্ষুদ্র মডেল বা ব্রেন অর্গানয়েড তৈরি করেন, যাতে দুটি ভিন্ন জিন পরীক্ষা করা হয়—একটি আধুনিক মানুষের NOVA1 জিন এবং অন্যটি নিয়ান্ডারথালদের পুরোনো সংস্করণ। দেখা যায়, সীসার সংস্পর্শে এলে নিয়ান্ডারথাল সংস্করণে FOXP2 নামের একটি জিনে মারাত্মক প্রভাব পড়ে, যা ভাষা ও কথাবার্তার বিকাশের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। কিন্তু আধুনিক মানুষের NOVA1 জিনে এই প্রভাব তুলনামূলক কম ছিল।
গবেষক অধ্যাপক আলিসন মউট্রি বলেন, “সম্ভবত আমাদের আধুনিক NOVA1 জিন সীসার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কিছুটা সুরক্ষা দিয়েছিল। এটি এক অবিশ্বাস্য উদাহরণ, যেখানে একটি পরিবেশগত বিষক্রিয়া (lead toxicity) আমাদের জিনগত বিবর্তনকে চালিত করেছে এবং ভাষা বিকাশে সাহায্য করেছে।”
গবেষণার আরেকজন সদস্য অধ্যাপক মানীশ অরোরা বলেন, “এই গবেষণা প্রমাণ করে যে পরিবেশগত প্রভাব কেবল আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর নয়, বরং বিবর্তনের ধারাতেও ভূমিকা রেখেছে। বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শ কখনো কখনো টিকে থাকার সুবিধাও এনে দিয়েছে।”
আজও সীসা দূষণ একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষ করে শিশুদের জন্য। এই গবেষণা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জিন ও পরিবেশের পারস্পরিক সম্পর্ক আমাদের প্রজাতিকে কোটি বছর ধরে গড়ে তুলেছে এবং আজও তা অব্যাহত।
আপনার মতামত জানানঃ