বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আন্তঃদেশীয় মানবপাচার বহুদিন ধরেই একটি গভীর সংকট হিসেবে বিদ্যমান। সম্প্রতি হায়দরাবাদ শহরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া এক কিশোরীকে উদ্ধার করার মধ্য দিয়ে এই সমস্যাটি আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে। এ ঘটনা শুধু কোনো একক অপরাধ নয়, বরং একটি দীর্ঘদিনের সংগঠিত অপরাধচক্রের প্রতিফলন, যেখানে দারিদ্র্য, প্রতারণা, মাফিয়া নেটওয়ার্ক এবং দুর্বল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একসাথে মিশে গেছে। গত দুই দশকে হায়দরাবাদ শহরে একাধিকবার পতিতালয় থেকে বাংলাদেশি নারীদের উদ্ধার করা হয়েছে, আর প্রতিবারই এই প্রশ্ন সামনে এসেছে—কীভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অবৈধভাবে মানুষ পাচার হয়, কারা এর সঙ্গে জড়িত, এবং কেন এত বছরেও এটি বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশ থেকে ভারতের হায়দরাবাদ পর্যন্ত নারীদের এই দীর্ঘ যাত্রাপথ মূলত শুরু হয় দারিদ্র্য আর হতাশার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে অতি দরিদ্র পরিবারগুলো প্রতিদিন বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। এসব পরিবারের মেয়েরা যখন কোনো কাজের সুযোগ খোঁজে, তখনই দালালরা তাদের ফাঁদে ফেলে। কখনো চাকরির প্রতিশ্রুতি, কখনো সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে, আবার কখনো বিয়ে বা অভিবাসনের নামে এসব নারী ও কিশোরীদের প্রলুব্ধ করা হয়। একবার সীমান্ত অতিক্রম করার পর তাদের ভাগ্য আর নিজেদের হাতে থাকে না। সীমান্তে দালালদের নেটওয়ার্ক এত শক্তিশালী যে প্রায়শই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের থামাতে পারে না। স্থলপথে নদী বা জঙ্গল পার হয়ে কিংবা সমুদ্রপথে মাছ ধরা বা ভ্রমণের অজুহাতে এদের ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়।
ভারতে প্রবেশ করার পরপরই নারীদের নতুন পরিচয় দেওয়া হয়। জাল পরিচয়পত্র তৈরি করে তাদেরকে বিভিন্ন শহরে পাঠানো হয়। কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, হায়দরাবাদ—এসব শহরেই বাংলাদেশি নারীরা সবচেয়ে বেশি পতিতাবৃত্তির শিকার হয়েছেন বলে তদন্তে জানা গেছে। শহরের অভিজাত এলাকাগুলো থেকে শুরু করে প্রান্তিক মহল্লাগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে এদের নেটওয়ার্ক। হায়দরাবাদে পতিতাবৃত্তির প্রধান ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে আত্তাপুর, বান্দলাগুদা, চিন্তালমেট, হিমায়তসাগর রোড এবং চম্পাপেট এলাকা। এগুলোতে একদিকে ভাড়া বাসা কিংবা লজ ব্যবহৃত হয়, অন্যদিকে রয়েছে বড় পতিতালয়। সংগঠকরা ভাড়াটে মাফিয়াদের মাধ্যমে পুরো ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে।
পুলিশের তথ্যমতে, এই পাচারচক্র কেবল বাংলাদেশি নারীদের নয়, উজবেকিস্তান, রাশিয়া, ইউক্রেন, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের নারীদেরও একইভাবে ব্যবহার করছে। তাদের modus operandi প্রায় একই—চাকরির প্রলোভন, ভালো বেতনের প্রতিশ্রুতি, কিংবা বিদেশে নতুন জীবন শুরু করার আশা দেখিয়ে নারীদের নিয়ে আসা হয়। পরে তাদের আটকে রেখে জোরপূর্বক যৌনপেশায় নামানো হয়। যারা রাজি না হয়, তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। পুলিশের উদ্ধার করা নারীদের সাক্ষ্যে উঠে এসেছে, অনেককে দিনের পর দিন খাবার না দিয়ে কিংবা মারধর করে বাধ্য করা হয়েছিল গ্রাহক গ্রহণে।
বাংলাদেশ থেকে আসা নারীদের মধ্যে বেশিরভাগই কিশোরী। চরম দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলগুলো থেকে তাদের সংগ্রহ করা হয়। সীমান্তে দালালরা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি বা দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের অর্থ দিয়ে নিরাপদ যাত্রার ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশে যেসব পরিবার থেকে এসব কিশোরী আসে, তাদেরকে প্রায়ই বলা হয়—মেয়েরা ভারতে গিয়ে গৃহকর্মী বা ফ্যাক্টরিতে কাজ করবে এবং ভালো বেতন পাঠাবে। বাস্তবে তারা পতিতালয়ে বন্দি হয়ে পড়ে, আর সেই টাকা কখনো পরিবারের কাছে পৌঁছায় না।
ভারতের কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণ বোর্ডের (CSWB) একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে চমকে দেওয়া তথ্য। ভারতে বাণিজ্যিক যৌনশোষণের শিকার হওয়া নাগরিকদের মধ্যে অন্তত ২.৭ শতাংশ বাংলাদেশি। এ থেকে বোঝা যায় যে, কেবল একক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী এই জালিয়াতি ও মানবপাচারের শিকার হচ্ছে। কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই এবং হায়দরাবাদে এই বাংলাদেশি নারীদের বিক্রি করা হয় স্থানীয় দালালদের কাছে, যারা পরবর্তীতে তাদের জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে ঠেলে দেয়।
বাংলাদেশি কিশোরী ও নারীদের উদ্ধারের ঘটনা হায়দরাবাদে নতুন নয়। ২০০০ সালের গোড়ার দিক থেকেই পুলিশ এ ধরনের অভিযান চালাচ্ছে। খয়রাতাবাদ, চাদেরঘাট ও বান্দলাগুড়ার পতিতালয় থেকে বাংলাদেশি নারীদের উদ্ধার করা হয়েছে একাধিকবার। প্রতিবারই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জোর দিয়ে বলেছে, তারা এই মাফিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কিছুদিন পরেই নতুন করে নারীরা ওই এলাকায় পাচার হয়ে আসছে। এর মানে হলো, পাচারকারীদের নেটওয়ার্ক ভাঙার মতো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পুলিশের হাতে কয়েকজন দালাল ধরা পড়লেও মূল সংগঠকরা থেকে যাচ্ছে অদৃশ্য, যারা বাইরে থেকে পুরো চক্রকে পরিচালনা করছে।
মানবপাচারের পেছনে সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি হলো দারিদ্র্য। বাংলাদেশে এখনও অনেক পরিবার প্রতিদিনকার খাবারের নিশ্চয়তা পায় না। কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে। মেয়েদের শিক্ষার অভাব এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাও তাদের ঝুঁকিতে ফেলে। পাচারকারীরা এই দারিদ্র্য ও হতাশাকে কাজে লাগিয়ে নারীদের প্রতারণা করে। অনেক সময় বাবা-মায়ের অজান্তেই কিশোরীরা এজেন্টদের সঙ্গে চলে যায়, আবার কখনো পরিবারকেও বিভ্রান্ত করা হয়।
অন্যদিকে, ভারতে পতিতালয় শিল্প একটি বিশাল অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। কোটি কোটি টাকার এই ব্যবসা পরিচালিত হয় সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধচক্রের মাধ্যমে। স্থানীয় মাফিয়া, রাজনৈতিক প্রভাবশালী, দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ কর্মকর্তা—সবাই মিলে একটি সুরক্ষা বলয় তৈরি করে। ফলে উদ্ধার হওয়া কয়েকজন নারী হয়তো বাড়ি ফিরে যেতে পারে, কিন্তু ব্যবসা বন্ধ হয় না। আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করে নারী পাচার হওয়ার ফলে এটি কেবল একটি দেশের আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়, বরং দুই দেশের কূটনৈতিক ও মানবাধিকার ইস্যুতেও পরিণত হয়েছে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমন্বিতভাবে এই চক্র ভাঙা না গেলে সমস্যা থেকে যাবে। সীমান্ত নজরদারি আরও কঠোর করা দরকার, পাশাপাশি দালাল চক্রকে আইনের আওতায় আনতে হবে। কেবল উদ্ধার অভিযান চালিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না, কারণ নারীরা পাচার হওয়ার পরই সমস্যাটি শুরু হয়। মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত তাদের পাচার প্রতিরোধ করা। এজন্য প্রয়োজন গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি।
ভারতীয় পুলিশ কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন, বাংলাদেশ থেকে আসা অনেকেই দারিদ্র্যের কারণে পুরুষ, নারী ও শিশুরা অবৈধভাবে প্রবেশ করে। তারা ধরা না পড়া পর্যন্ত নিজেদের বাঙালি পরিচয় ব্যবহার করে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত থাকে। কিন্তু সমস্যা হলো, একবার যখন তারা দালাল চক্রের হাতে চলে যায়, তখন আর ফিরে আসা কঠিন হয়ে যায়। তাদের নথি জাল করা হয়, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়, আর প্রতিরোধ করলে হুমকি দেওয়া হয়।
এই সমস্যার আরেকটি দিক হলো সামাজিক কলঙ্ক। যারা উদ্ধার হয়েও দেশে ফেরত আসে, তাদের প্রায়ই সমাজে অবহেলা করা হয়। পরিবার ও সমাজ তাদের গ্রহণ করতে চায় না। ফলে অনেক নারী আবারও দালাল চক্রের হাতে ফিরে যায়। পাচার হওয়া নারীদের পুনর্বাসন তাই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার ও বেসরকারি সংগঠনগুলো এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে তাদের সমাজে ফিরিয়ে আনা জরুরি।
হায়দরাবাদে একের পর এক বাংলাদেশি নারী উদ্ধারের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে, এটি কোনো একদিনের সমস্যা নয়। এটি একটি সংগঠিত অপরাধ, যার শিকড় দুই দেশের ভেতরেই গভীরভাবে প্রোথিত। বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও সামাজিক অস্থিরতা, ভারতের পতিতালয় শিল্পের চাহিদা, আর দুই দেশের সীমান্তে দুর্বল নজরদারি—এই তিনটি উপাদান একসাথে মিলে মানবপাচারকে টিকিয়ে রেখেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, সমাধান কোথায়? প্রথমত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কেবল ছোট দালাল ধরলেই চলবে না, বরং মূল নেটওয়ার্ক ও অর্থের জোগানদাতাদের চিহ্নিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সীমান্ত সুরক্ষা আরও কড়া করা দরকার, বিশেষ করে স্থল ও সমুদ্রপথে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনমূলক কার্যক্রম বাড়াতে হবে, যাতে কেউ চাকরির প্রলোভনে দেশ ছাড়তে বাধ্য না হয়। আর চতুর্থত, উদ্ধার হওয়া নারীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন প্রোগ্রাম চালু করা জরুরি।
বাংলাদেশ থেকে হায়দরাবাদ পর্যন্ত এই পাচারের কাহিনি কেবল একটি শহরের ঘটনা নয়, বরং বৈশ্বিক মানবপাচার সমস্যার প্রতিচ্ছবি। এ সমস্যার সমাধান কেবল আইনশৃঙ্খলার মাধ্যমে সম্ভব নয়, বরং সমাজ, রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সমন্বয় প্রয়োজন। প্রতিটি উদ্ধার হওয়া নারী আমাদের মনে করিয়ে দেয়—কোথাও না কোথাও আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। ব্যর্থ হচ্ছি আমাদের কিশোরী ও নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, ব্যর্থ হচ্ছি দারিদ্র্য ও বৈষম্যের শিকল ভাঙতে। এই ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে, হায়দরাবাদের পতিতালয়ে কিংবা অন্য কোনো শহরে বাংলাদেশের কিশোরীদের করুণ আর্তনাদ আরও বহুবার আমাদের কানে পৌঁছাবে।
আপনার মতামত জানানঃ