বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে, তবে দেশের একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রূপপুর নিয়ে নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ডিবিসি নিউজের তিন পর্বের অনুসন্ধানের প্রথম কিস্তিতে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, কেন্দ্রের কিছু স্পর্শকাতর পদে অভিজ্ঞতা ছাড়া ব্যক্তিদের নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, যা প্রকল্পের নিরাপত্তার জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাতা রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থা রোসাটম অভিযোগ করেছে যে, কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত চিফ সুপারইন্টেন্ডেন্ট মুশফিকা আহমেদকে ২০১৯ সালে কেমিক্যাল ও রেডিওঅ্যাক্টিভ ওয়েস্ট ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, যেখানে তার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল যে পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা রেডিয়েশন মনিটরিংয়ে অন্তত দুই বছরের অভিজ্ঞতা থাকা আবশ্যক। নিয়োগ কমিটির মধ্যে ছিলেন মুশফিকার দুলাভাই মইনুল ইসলাম তিতাস, যিনি তখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পারমাণবিক শক্তি উইং-এ অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে মুশফিকাকে পদোন্নতি দিয়ে কেন্দ্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তাজনিত পদে বসানো হয়, যা রোসাটমের কাছে আপত্তিকর মনে হয়েছে।
রোসাটমের নিয়ম অনুযায়ী চিফ সুপারইন্টেন্ডেন্ট পদের জন্য তাত্ত্বিক জ্ঞান, নির্দিষ্ট দক্ষতা এবং অন্তত এক বছরের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। এই যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ দেওয়া হলে প্রকল্পের নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে বলে তারা সতর্ক করেছেন।
এই ধরনের অভিযোগ শুধু মুশফিকাকে ঘিরেই সীমাবদ্ধ নয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৯ ও ২০২৩ সালের মধ্যে একাধিক নিয়োগে ভুয়া অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ এবং স্বজনপ্রীতির ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে মেকানিক্যাল বিভাগের ঊর্ধ্বতন সহকারী ব্যবস্থাপক পদে রবিউল আলমকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা পারমাণবিক স্থাপনায় অন্তত তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে বাস্তবে তিনি খুলনা পাওয়ার কোম্পানিতে চাকরির দাবি করলেও তখন ঠাকুরগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে খণ্ডকালীন ইন্সট্রাক্টর ছিলেন। বর্তমানে তিনি পদোন্নতি পেয়ে উপব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন।
এছাড়া, আল মামুন ও এ কে এম নাজমুল হাসানকে ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, যদিও তাদের বিএসসি পাশ করার নয় বছরও পূর্ণ হয়নি, যা ছিল নিয়োগের জন্য বাধ্যতামূলক অভিজ্ঞতার শর্ত। ২০২৩ সালের মে মাসে সশস্ত্র বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে অন্তত সাত বছরের অভিজ্ঞতার শর্ত থাকা সত্ত্বেও আবু কায়সার নামের একজনকে ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের অযোগ্য নিয়োগ ও স্বজনপ্রীতির ঘটনা কেন্দ্রের নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে এবং ভবিষ্যতে চেরনোবিলের মতো দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি করতে পারে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেখানে তাত্ত্বিক জ্ঞান, প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা এবং সুনির্দিষ্ট দক্ষতা থাকা বাধ্যতামূলক। এ ধরনের অনিয়ম দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ