মিয়ানমারের ভূরাজনৈতিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদ তাকে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ব রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত করেছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত এই দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান, বিরল খনিজ সম্পদ এবং বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় প্রবেশাধিকার তাকে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর স্বার্থ ও প্রতিযোগিতার মূল মঞ্চে নিয়ে এসেছে। বিশেষত রাখাইন রাজ্যের কৌশলগত গুরুত্ব—যেখানে গভীর সমুদ্রবন্দর, জ্বালানি অবকাঠামো এবং চীন-ভারতের বিনিয়োগ রয়েছে—এ অঞ্চলকে পরিণত করেছে বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনের একটি স্পর্শকাতর ক্ষেত্র হিসেবে।
২০২১ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর দেশটি গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত হয়। রাখাইনে আরাকান আর্মি নামে পরিচিত জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে স্বায়ত্তশাসন ও রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে আরাকান আর্মি রাখাইনের অধিকাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, এবং মিয়ানমার সেনারা সেই নিয়ন্ত্রণ ভাঙতে ধারাবাহিক হামলা চালাচ্ছে। এ সংঘাত শুধু মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ নেই; এটি সরাসরি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে প্রভাবিত করছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে রাখাইন রাজ্যের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। ফলে রাখাইনের অস্থিতিশীলতা সরাসরি সীমান্ত নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান, মানব পাচার, বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সক্রিয়তা—সব মিলিয়ে সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা বেড়েছে। ইতোমধ্যেই আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে রোহিঙ্গাদের নতুন ঢল আসতে শুরু করেছে, যা কক্সবাজার ও অন্যান্য ক্যাম্পে চাপ বাড়াচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অপরাধ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বৃদ্ধি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে।
এই সংকটের মাঝেও চীন ও ভারতের বিনিয়োগ রাখাইনে সক্রিয় রয়েছে। চীনের ‘চকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দর’ থেকে সরাসরি পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি কুনমিংয়ে পৌঁছায়। চীন সেখানে একাধিক বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলেছে এবং আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে তাদের স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। অন্যদিকে, ভারত বহু বছর ধরে কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে, যা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে মূল ভূখণ্ড এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক যোগাযোগ বাড়াবে। এই প্রকল্পের সমুদ্র ও নদীপথ শেষ হলেও স্থলপথের ১০৯ কিলোমিটার অংশ এখনো নির্মাণাধীন, যা ২০২৭ সালের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
রাশিয়াও মিয়ানমারের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠেছে। সামরিক জান্তা ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি সহযোগিতা বেড়েছে। রাশিয়া শুধু মিয়ানমারের অন্যতম অস্ত্র সরবরাহকারী নয়, বরং রাখাইনে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনেও বিনিয়োগ করেছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তারা মিয়ানমার বিমান বাহিনীকে ছয়টি সু-৩০ এসএমই যুদ্ধবিমান সরবরাহ করেছে। পাশাপাশি রাশিয়া-ভারত-মিয়ানমার করিডরের প্রস্তাব দিয়েছে, যা ভারতের কালাদান প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাশিয়ার পণ্যের বাজার বিস্তারে সহায়ক হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতেও মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে দেশের বিরল খনিজ সম্পদের কারণে। মার্কিন ‘বার্মা অ্যাক্ট’-এর লক্ষ্য মিয়ানমারে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে তারা চীনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিরল খনিজের বিকল্প উৎস হিসেবে মিয়ানমারকে বিবেচনা করছে। সম্প্রতি মিয়ানমার জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলের প্রশংসা করে একটি চিঠি পাঠান, যার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। বিশ্লেষকদের মতে, এই কূটনৈতিক পদক্ষেপ মূলত খনিজ সম্পদে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য।
এ সংঘাত ভারতের নিরাপত্তায়ও চাপ সৃষ্টি করেছে। মিয়ানমারের সহিংসতা থেকে পালিয়ে অনেক সাধারণ মানুষ ও সামরিক বাহিনীর সদস্য ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর কার্যক্রম বেড়েছে, এমনকি মিয়ানমারের অভ্যন্তরে এসব গোষ্ঠীর ওপর ড্রোন হামলাও চালানো হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য এই পরিস্থিতি আরও জটিল কারণ রোহিঙ্গা সংকট এখন নিরাপত্তাজনিত সমস্যায় পরিণত হয়েছে। দেশে থাকা প্রায় সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাচ্ছে, জন্মহার বাড়ছে, এবং গত ১৮ মাসে দেড় লাখ নতুন রোহিঙ্গা এসেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার সরকারের সম্মতি থাকলেও আরাকান আর্মির অনুমতি ছাড়া এটি সম্ভব নয়, কারণ বর্তমানে তারা অধিকাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য জরুরি কৌশল হলো—মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মি উভয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করা, রোহিঙ্গা সমস্যায় আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখা এবং ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মধ্যে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব নয়। একইসঙ্গে সীমান্ত ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সুরক্ষায় গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয় বাড়াতে হবে, যাতে এই সংঘাতের প্রভাব বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ না করে।
সংক্ষেপে, মিয়ানমারে পরাশক্তির স্বার্থ ও সংঘাত শুধু সে দেশের নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান তাকে একদিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে, অন্যদিকে সুযোগও সৃষ্টি করছে। এই সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করেই বাংলাদেশকে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ