গোপালগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত চারজনের লাশ সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত ছাড়াই তড়িঘড়ি করে দাফন ও দাহ সম্পন্ন হয়েছে। ফলে প্রকৃতভাবে কার গুলিতে বা কীভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছে, সেটি আর জানা সম্ভব হবে না বলেই মত দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। একে শুধু আইনি বিচ্যুতি বলেই নয়, বরং অপরাধ গোপনের একটি “তৎপর প্রচেষ্টা” হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ।
বুধবার জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শহরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এতে চারজন নিহত এবং অন্তত ৫০ জন আহত হন। নিহতরা হলেন দীপ্ত সাহা, রমজান কাজী, সোহেল রানা ও ইমন তালুকদার। অথচ আইন অনুযায়ী, এমন সহিংসতায় নিহতদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ণয়ে ময়নাতদন্ত বাধ্যতামূলক। কিন্তু পুলিশের ভাষ্য, পরিবারগুলো লাশ জোরপূর্বক নিয়ে গেছে, ফলে ময়নাতদন্ত করা যায়নি। যদিও নিহতদের পরিবাররা বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
এরপর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে—এভাবে মৃত্যু হওয়ার পর লাশ দাফন করে ফেললে তদন্ত-প্রক্রিয়া কীভাবে চলবে? একজন আইনজীবীর ভাষায়, এটি “ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশনের ক্ষেত্রে একটি গুরুতর গাফিলতি”, যেখানে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট মূল প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গুলির ধরন, অস্ত্রের উৎস, দেহে আঘাতের ধরন—সবকিছুই উঠে আসে ময়নাতদন্তে। এমনকি ব্যালাস্টিক টেস্টে গুলি শনাক্ত করে দায়ীদের শনাক্ত করা সম্ভব হতো। এখন সেই প্রমাণের পথটাই বন্ধ হয়ে গেল।
এদিকে, পুলিশের দাবি, তারা কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেনি। সেনাবাহিনীও বলেছে, “আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগ” করেছে, কিন্তু গুলি ছোড়ার কথা স্বীকার করেনি। অথচ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে গুলির শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তাহলে গুলি চালাল কে? কার অস্ত্রের গুলিতে প্রাণ গেল চারজনের?—এই প্রশ্নের কোনো নির্ভরযোগ্য উত্তর নেই। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আসক (আইন ও সালিশ কেন্দ্র) জানিয়েছে, গুলির প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও দায় স্বীকার না করায় জনমনে ভয়, বিভ্রান্তি ও প্রশাসনের ওপর অনাস্থা বাড়ছে।
২০২৪ সালে অভ্যুত্থান চলাকালে শতাধিক গুলিবিদ্ধ ছাত্র-জনতার লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়া দাফন হয়েছিল, সে অভিজ্ঞতাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন অনেকে। তখনও পরবর্তীতে কিছু লাশ উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করতে হয়েছিল, যদিও অনেক পরিবার রাজি হননি।
গোপালগঞ্জের পরিস্থিতিও এখন এমন এক আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে পরিবারগুলো হয়তো ভয় বা রাজনৈতিক চাপের কারণে মুখ খুলতে চাইছে না। শহরে কারফিউ, সেনা মোতায়েন, গ্রেপ্তার আতঙ্ক এবং আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের এলাকা ত্যাগ—সব মিলিয়ে এক ধরনের চাপা দমন-পীড়নের আবহ তৈরি হয়েছে।
সরকার তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব। তাদের ১৪ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একাধিক ঘটনায় যখন প্রমাণ নষ্ট হয়ে গেছে বা আটকে রাখা হয়েছে, তখন তদন্ত কতটা নিরপেক্ষ, তার ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না অনেকেই।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি জানালেও যে, গ্রেপ্তার হওয়া ২৪ জনের মধ্যে অনেকেই ‘বাইরের’ এবং তারা সংঘর্ষ উস্কে দিতে গোপালগঞ্জে এসেছিল—তবে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় বা উদ্দেশ্য কী, তা স্পষ্ট করা হয়নি।
এদিকে গুলিবিদ্ধ আহত আব্বাস আলী সরকারের গায়ে এখনো একটি গুলি রয়ে গেছে। তিনি বলেন, “অপারেশন করতে হবে, অনেক টাকা লাগবে, ভাইরে। খুব কষ্ট হচ্ছে।” এই মানুষগুলোর দুর্দশাও যেন এই সংঘাতের নীরব সাক্ষ্য হয়ে আছে।
তবে মূল প্রশ্নটি রয়ে গেছে—এদের গুলি করল কে? আর কেন এই মৃত্যুদের তদন্তচক্রেই চাপা পড়ে যেতে হলো?
যদি এই ঘটনা “রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতার” প্রশ্নে ব্যর্থতার নজির হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও অনেক লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফনের পথ তৈরি হয়ে যাবে। আর তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ন্যায়বিচার, আর নাগরিকের নিরাপত্তার বোধ হয়ে পড়বে আরও দুর্বল।
আপনার মতামত জানানঃ