যশোর ও নড়াইলে একাধিক পথসভায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে—বাংলাদেশে আর কোনো ফ্যাসিবাদী সরকার টিকে থাকতে পারবে না। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, বৈষম্য এবং বিচারহীনতার বিরুদ্ধে জনগণের একটি নতুন শক্তি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছে এনসিপি। আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও অন্য নেতাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা, ইনসাফভিত্তিক রাজনীতি এবং কাঠামোগত সংস্কারের অপরিহার্যতা। এই প্রতিবেদনে আমরা খতিয়ে দেখব এনসিপির বক্তব্য, তাদের অবস্থান, এবং বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাদের গুরুত্ব।
যশোর শহরের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মোড়ে শুক্রবার বিকেলে অনুষ্ঠিত পথসভায় এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, দেশে আরেকটি বড় আন্দোলন আসন্ন। বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “তাদের দল নাকি কোটি মানুষের। লক্ষ-কোটি মানুষ আমাদের দেখায়েন না; আমরা জানি কার কত মানুষ।” তাঁর ভাষায়, ইনসাফ ও ন্যায়ের সঙ্গে থাকলে একজন কর্মী এক লাখ মানুষের থেকেও শক্তিশালী হয়ে যায়। তিনি সরাসরি ঘোষণা দেন—যারা দুর্নীতি করবে, চাঁদাবাজি করবে, এনসিপি তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে।
এই বক্তব্য নিছক হুঁশিয়ারি নয়; বরং এটি একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা। তিনি বলেন, “যারা সংস্কারে বাধা দিচ্ছে, তারাই নির্বাচনকে পিছিয়ে দিচ্ছে।” এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতাসীনদের প্রতি ইঙ্গিত করেই বলতে চেয়েছেন, দেশে একটি ন্যায্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো মৌলিক রাজনৈতিক সংস্কার।
নাহিদ ইসলামের মতে, বিচার, সংস্কার ও গণতান্ত্রিক ভিত্তির পুনর্নিমাণ ছাড়া কোনো নির্বাচন সফল হতে পারে না। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “আমরা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করতে দেব না। পুলিশ প্রশাসন নির্দলীয় থাকবে।” এ বক্তব্য বাংলাদেশে একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয়তার দিকেই ইঙ্গিত করে, যেটি গত ১৬ বছরে সবচেয়ে বেশি দলীয়করণের শিকার হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
এনসিপির মূল বার্তায় আরও উঠে এসেছে জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রসঙ্গ। আখতার হোসেন বলেন, “আমরা ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই, কিন্তু দাদাগিরি মেনে নেব না।” তাঁর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে এনসিপি চায় এক স্বাধীন ও মর্যাদাশীল বাংলাদেশ, যেখানে কোনো বিদেশি শক্তির অনধিকার হস্তক্ষেপ চলবে না।
পথসভায় আরও বক্তব্য রাখেন এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, এবং ডা. মাহমুদা রিকু সহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। বক্তৃতাগুলোতে উঠে আসে যশোর ও বেনাপোলের স্থানীয় সমস্যা, বিশেষত জলাবদ্ধতা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অব্যবস্থা, এবং মানবপাচার সম্পর্কিত উদ্বেগ।
সাম্প্রতিক সময়ে এনসিপি শুধু কথা বলেই থেমে থাকেনি, তারা মাঠেও সক্রিয় হয়েছে। যশোরে পথসভা শেষে তারা শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহতদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। ৩২ নম্বর ভাঙা ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, “কোনো কোনো রাজনীতিক এসব ঘটনাকে ‘মব’ বলছেন। কিন্তু আমরা জানি এগুলো জনগণের আত্মত্যাগের অংশ। কেউ এনসিপিকে নির্বাচনবিরোধী বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু আমরা স্পষ্ট বলছি—আমরাও নির্বাচন চাই, তবে বিচার-সংস্কার ছাড়া নয়।”
নড়াইলে অনুষ্ঠিত আরেকটি পথসভায় নাহিদ ইসলাম বলেন, “গণহত্যার বিচার, মৌলিক সংস্কার এবং নতুন সংবিধান ছাড়া আমরা কোনো নির্বাচন চাই না।” বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “তারা বিচার ও সংস্কারকে এড়িয়ে গিয়ে তড়িঘড়ি করে নির্বাচন আয়োজন করতে চায়, যা জনগণের জন্য বিপজ্জনক।” তাঁর মতে, একটি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আগে নতুন সংবিধান প্রয়োজন, যাতে ইনসাফ ও গণতন্ত্রের ভিত্তি নিশ্চিত হয়।
এই বক্তৃতাগুলোতে বারবারই উঠে এসেছে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান’-এর প্রসঙ্গ। এনসিপি বলছে, এই অভ্যুত্থান ছিল জনগণের বঞ্চনার বিরুদ্ধে একটি ন্যায্য প্রতিরোধ। যদি সেই দাবিসমূহ বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে আবারও গণ-আন্দোলন ডাকা হবে। যারা বিরোধিতা করবে, তাদের লাল কার্ড দেখানো হবে বলে ঘোষণা এসেছে।
এনসিপির বক্তব্য ও অবস্থান বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তারা নিজেকে ধীরে ধীরে একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের পক্ষে, ইনসাফের ভিত্তিতে সমাজ গঠনের কথা বলছে। যদিও এখনো পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে এই দলটি তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি, তবে স্থানীয় পর্যায়ে তাদের জনপ্রিয়তা এবং সাংগঠনিক গতিশীলতা বাড়ছে। বিশেষত, তারা যে ‘সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়’—এই বার্তা বারবার দিচ্ছে, তা বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশের জনগণ বহুদিন ধরেই একটি নিরপেক্ষ, নির্ভীক এবং ইনসাফভিত্তিক রাজনৈতিক দল চেয়ে আসছে। এনসিপি সেই প্রত্যাশার আলো জ্বালাতে চাচ্ছে। তবে ভবিষ্যতই বলে দেবে তারা কতটা সফল হবে। কিন্তু এখন অন্তত এটুকু নিশ্চিত যে, এনসিপির মতো দলগুলোর প্রবাহ রাজনীতির গতিপথে নতুন মাত্রা আনছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই বার্তাই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক: নির্বাচন চাই, তবে ইনসাফ ছাড়া নয়।
আপনার মতামত জানানঃ