মশারা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন পতঙ্গ। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মশারা প্রায় এক কোটি বছর আগে পৃথিবীতে এসেছে। সেই সময় ছিল ক্রিটেসিয়াস যুগ, যখন ডাইনোসরদের যুগ চলছিল। পৃথিবীর পরিবেশ তখন আজকের মতো ছিল না; বেশি গাছ-গাছালি, বড় বড় জলাশয় এবং আর্দ্র বনভূমি ছিল। মশাদের প্রথম আবির্ভাব সেই প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যেই ঘটে বলে ধারণা করা হয়।
প্রাচীন জীবাশ্ম গবেষণার মাধ্যমে মশাদের উৎপত্তি বোঝা যায়। জীবাশ্ম হলো পাথরের ভেতরে আটকে যাওয়া প্রাণীর বা উদ্ভিদের অংশ, যা অনেক লাখ বছর আগের হতে পারে। মশার জীবাশ্ম বিশেষ করে অ্যাম্বার (গাছের রস থেকে তৈরি কঠিন পদার্থ) মধ্যে পাওয়া গেছে। মায়ানমার এবং কানাডার অ্যাম্বার থেকে পাওয়া মশার জীবাশ্ম দেখায়, প্রায় ৯০ থেকে ১১০ মিলিয়ন বছর আগে মশারা আধুনিক মশার মতোই গঠন ধারণ করেছিল। অর্থাৎ তাদের পাখা, পা এবং ঠোঁট আজকের মশাদের মতোই ছিল।
প্রথম মশারা সম্ভবত রক্ত খায়নি, তারা ফুলের রস এবং উদ্ভিদের রস খেয়ে বেঁচে ছিল। কিন্তু নারীর মশারা পরবর্তীতে রক্ত আহারের জন্য বিবর্তিত হয়। এই রক্ত আহার নারীর প্রজননের জন্য অত্যন্ত জরুরি, কারণ রক্তে থাকা প্রোটিন ডিম গজাতে সাহায্য করে। পুরুষ মশারা ফুলের রস থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করে।
মশার উৎপত্তি মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে হয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার কিছু অংশ ছিল মশাদের প্রাথমিক আবাস। এই অঞ্চলে প্রচুর জলাশয় ও আর্দ্র পরিবেশ থাকার কারণে মশারা সহজেই বিস্তার লাভ করেছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা বিভিন্ন পরিবেশে মানিয়ে নিতে শুরু করে। জলাভূমি, বন, নিকৃষ্ট পানি—সবখানেই তারা নিজেদের বসবাস প্রতিষ্ঠিত করে।
মানুষের আবাসনের বিস্তার ও বাণিজ্যিক যোগাযোগের কারণে মশারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। প্রাচীন বাণিজ্য পথ ও সামুদ্রিক যাত্রার ফলে আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে মশা পৌঁছায়। আজ পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায় মশা পাওয়া যায়; শুধু অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া। মশাদের এই বিস্তার তাদের অভিযোজন ক্ষমতার কারণে সম্ভব হয়েছে। তারা গরম, ঠান্ডা, আর্দ্র কিংবা শুষ্ক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
মশার বিবর্তন শুধু শারীরিক গঠনের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ঠোঁট আজ একটি সূঁচের মতো গঠিত, যা প্রাণীর চামড়া সহজে ছিদ্র করতে পারে। এই পরিবর্তন তাদের রক্ত আহারে দক্ষ করে তুলেছে। পাশাপাশি পাতলা পাখা ও লম্বা পা মশাদের দ্রুত ও চুপচাপ চলাফেরা করতে সাহায্য করে।
তবে মশারা শুধু মানুষের জন্য বিপদ নয়; প্রকৃতিতে তাদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অনেক পাখি, মাছ ও বাদুড় মশার ডিম ও লার্ভা খেয়ে বেঁচে থাকে। তাই তারা খাদ্য শৃঙ্খলের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
পরিশেষে বলা যায়, মশাদের পৃথিবীতে আগমন ও বিস্তার প্রকৃতির বিবর্তনের এক চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত। তারা যে কতটা দীর্ঘকাল ধরে পৃথিবীতে রয়েছে এবং কীভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন পরিবেশে খাপ খাইয়ে বেঁচে রয়েছে, তা আমাদের জীববিজ্ঞান ও পরিবেশবিদ্যার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মশাদের এই ইতিহাস ও বিবর্তন আমাদের শেখায়, প্রাকৃতিক পরিবেশে ছোট ছোট পরিবর্তন কিভাবে জীবজগতের বৃহৎ রূপান্তর ঘটায়।
আপনার মতামত জানানঃ