আমাদের পৃথিবীতে একসময় এমন সময় ছিল যখন যৌনতা বলে কিছু ছিল না। জীবনের শুরুতে সমস্ত জীবজন্তু এককোষীয় ও একবংশবাহী ছিল। অর্থাৎ তারা নিজেদের কোনো সঙ্গীর প্রয়োজন ছাড়াই নিজেদের ক্লোন করে বংশ বিস্তার করত। এই ছিল জীবনের সবচেয়ে সহজ, দ্রুত এবং কার্যকর পদ্ধতি। প্রত্যেক সদস্য স্বতন্ত্রভাবে বংশবিস্তার করত, নিজেকে দুই ভাগে বিভক্ত করে তাদের ডিএনএ নকল করত। খাবার খাওয়া এবং শিকার থেকে বাঁচার পাশাপাশি একমাত্র কাজ ছিল জীবের এই পুনরুৎপাদন।
কিন্তু এই এককোষীয় জীবজন্তুরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নত হতে শুরু করলো। প্রোক্যারিওট নামক এককোষীয় প্রাণীরা একে অপরের সাথে ডিএনএ আদান-প্রদান করতে শিখল, যা তাদের জাতিকে নতুন বৈশিষ্ট্য ও অভিযোজনের সুযোগ দেয়। তবুও এদের সন্তানদের ডিএনএ ছিল মূলত তাদের নিজের ডিএনএ-এর মিশ্রণ।
প্রায় এক থেকে দুই বিলিয়ন বছর আগে একটি বড় পরিবর্তন ঘটে। প্রথম ইউকারিওট (যাদের কোষের ভেতরে সুনির্দিষ্ট নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্রীয় অংশ থাকে) উদ্ভূত হয়। এই এককোষীয় জীব একই সাথে নিজের কোষও ক্লোন করতে পারতো, কিন্তু তারা নতুন ধরনের কোষ তৈরি করতে শুরু করলো—যেগুলো ছিল হ্যাপলয়েড বা অর্ধেক ডিএনএ ধারণকারী। এগুলো ছিল গামেট বা যৌন কোষ, যা অন্য গামেটের সাথে মিলিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ তৈরি করত। এই হলো যৌন প্রজননের মূল ভিত্তি।
বাংগিয়োমরফা পাবেসেন্স (Bangiomorpha pubescens) নামক একপ্রাচীন অ্যালগাই (শৈবাল) প্রজাতি, যাদের জীবাশ্ম প্রায় এক বিলিয়ন বছর পুরানো, আমাদের সবচেয়ে প্রাচীন যৌন প্রজননের প্রমাণ দেয়। এদের স্পোর বা বীজাণু তিনরকম আকৃতির—এক ধরনের যা দিয়ে তারা নকল করত (অবিভাজিত বংশবিস্তার), এবং দুটো আকৃতি যা আধুনিক শৈবালের পুরুষ ও স্ত্রী গামেটের মতো ছিল। এর মানে, জীবের সেই প্রাচীন পূর্বপুরুষদের মধ্যে যৌন প্রজননের শুরুর ছাপ পাওয়া যায়।
আমরা জানি, আজকের ইউকারিওট জীবেরা যাদের মধ্যে মানুষ, পশু, গাছপালা সব রয়েছে, তাদের পূর্বপুরুষদের যৌন প্রজননের ইতিহাস ছিল। এমনকি যাদের প্রজাতি আজ একবংশবাহী, তারা হয়তো অতীতে যৌন ও অযৌন প্রজননের উভয় ধরণ প্রয়োগ করতো।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আধুনিক অর্থে যৌন সম্পর্ক বা মিলন শুরু হয় অনেক পরে। প্রায় ৩৮৫ মিলিয়ন বছর আগে মাইক্রোব্রাকিয়াস ডিকি (Microbrachius dicki) নামে এক ধরনের প্রাচীন মাছের জীবাশ্ম থেকে আমরা প্রথমবারের মতো অভ্যন্তরীণ সারোগাম বা যৌন মিলনের প্রমাণ পাই। এই মাছের পুরুষের লম্বা ল-আকৃতির একটি হাড়ের অঙ্গ ছিল, যা দিয়ে তারা স্ত্রী মাছের মধ্যে শুক্রাণু প্রবাহিত করতো। স্ত্রী মাছের দেহে ছিল সেসব পুরুষাঙ্গকে ধরে রাখার জন্য ছোট হাড়ের অঙ্গ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এরা মিলনের সময় দুজন মিলে হাত মেলানো বা ডান্সের মতো পারস্পরিক যোগাযোগ করতো—এটিকে ‘স্কয়ার ড্যান্সিংয়ের মতো’ বলা হয়েছে।
আমাদের আজকের মানুষের মিলন প্রক্রিয়া থেকে এটা অনেক দূরে, তবে এখান থেকেই শুরু।
যৌনতা কেন শুরু হলো, তার উত্তরে একদম সহজ বা সরল নয়। কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, যৌন প্রজনন জীবজগতকে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ ও অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন করেছে, যা প্রাকৃতিক নির্বাচনে সহায়ক। একবংশবাহী প্রজননে সমস্ত সন্তান একই ধরনের ডিএনএ ধারণ করে, তাই তারা পরিবেশগত পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কম সক্ষম হয়। যৌন প্রজননে ডিএনএ মিশ্রিত হওয়ায় নতুন বৈশিষ্ট্যের জন্ম হয়, যা জীবের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ায়।
মাইক্রোব্রাকিয়াস ডিকি-র মতো জীবাশ্ম থেকে পাওয়া তথ্য ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় নিশ্চিত করে যে, অভ্যন্তরীণ সারোগাম শুরু হয়েছিল সেই সময় থেকেই। এর আগে যৌন প্রজনন অনেক বেশি সরল ছিল, যেমন শৈবাল বা প্রথম ইউকারিওটদের স্পোর ছড়িয়ে দেওয়া। মাইক্রোব্রাকিয়াসের ‘ক্ল্যাসপার’ নামক যৌনাঙ্গের আবিষ্কার একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এনে দেয় যৌনতার বিবর্তনের উপর।
এছাড়া জীববিজ্ঞানে পাওয়া তথ্য থেকে দেখা যায়, আধুনিক প্রাণী ও উদ্ভিদদের মধ্যে যৌন প্রজনন কতটা জটিল ও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে, সেটা এই প্রাচীন উদ্ভিদের থেকে অনেক দূর।
জীবনের ইতিহাসে যৌনতার আবির্ভাব এক বিরাট মাইলফলক। এককোষীয় জীব থেকে শুরু করে আজকের মানুষের যৌন প্রক্রিয়ায় এসেছে অসংখ্য পরিবর্তন ও বিবর্তন। আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা প্রথমে নিজেরাই নিজেদের ক্লোন করত, পরে দুই কোষ মিলিত হয়ে নতুন জীবন তৈরি করল, তারপর শারীরিক মিলনের জটিল রূপ দাঁড়িয়ে গেল। এই যাত্রাপথে রয়েছে অনেক অজানা গল্প, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং অবাক করা তথ্য। আমাদের নিজেদের জীবনচক্র ও সমাজের অনেক কিছুই ঘিরে রয়েছে যৌনতার এই চমকপ্রদ ইতিহাসের ছায়া।
আপনার মতামত জানানঃ