প্রাচীন মানুষরা কিভাবে সমুদ্র পাড়ি দিতেন—এই প্রশ্ন আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যতটা অবাস্তব মনে হয়, হাজার বছর আগে তা ছিল তাদের বাস্তবতা। আধুনিক প্রযুক্তি, মানচিত্র, কম্পাস, কিংবা জিপিএসের তো প্রশ্নই ওঠে না, সেই সময় তারা কেবল সূর্য, ঢেউ এবং অন্তর্দৃষ্টির উপর নির্ভর করেই উত্তাল সাগর অতিক্রম করেছিলেন। ‘ইউনিভার্সিটি অব টোকিও’র অধ্যাপক ইয়োসুকে কাইফুর নেতৃত্বে পরিচালিত একটি চমকপ্রদ গবেষণা সেই সাহসিকতারই এক জীবন্ত প্রমাণ তুলে ধরেছে।
এই গবেষণায় মূল প্রশ্ন ছিল—প্রাচীন মানুষরা কীভাবে আজকের তাইওয়ান থেকে জাপানের দক্ষিণের দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছাতেন? কাইফু ও তার দল এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন আধুনিক প্রযুক্তি নয়, বরং প্রাগৈতিহাসিক কৌশল ও সরঞ্জামের সাহায্যে। তারা পাথরের যন্ত্রপাতি দিয়ে একটি ৭.৫ মিটার লম্বা কাঠের নৌকা তৈরি করেন, ঠিক যেমনটি হাজার বছর আগে মানুষ ব্যবহার করত বলে অনুমান করা হয়। এই নৌকা বানাতে তারা ব্যবহার করেন জাপানি দেবদারু গাছ—যা থেকে ‘সুগিম’ নামের ওই জলযান তৈরি করা হয়।
২০১৯ সালে গবেষক দলটি এ নৌকা নিয়ে পূর্ব তাইওয়ান থেকে ইয়োনাগুনি দ্বীপ পর্যন্ত প্রায় ২২৫ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দেন, সময় লাগে ৪৫ ঘণ্টারও বেশি। ন্যূনতম কোনো প্রযুক্তিগত সহায়তা ছিল না—না ছিল মানচিত্র, না ছিল কম্পাস কিংবা জিপিএস। পথ চিনতে তারা নির্ভর করেন সূর্য, ঢেউয়ের ধারা এবং নিজেদের অভিজ্ঞতার উপর। তাদের সফলতা এই ধারণাকেই আরও দৃঢ় করে যে, প্রাচীন মানুষেরা নিছক বেঁচে থাকার চেয়ে অনেক বেশি কিছু জানত—তারা প্রকৃতিকে ভালোবাসত, পর্যবেক্ষণ করত, এবং শেখার অসীম আগ্রহ ছিল তাদের মধ্যে।
গবেষণা দলের দাবি অনুযায়ী, প্রাচীন মানুষদের সমুদ্র যাত্রা ছিল উদ্দেশ্যমূলক এবং তারা ‘পথ হারিয়ে’ কোনো দ্বীপে পৌঁছে যেতেন না। শত শত কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে গবেষকরা দেখিয়েছেন, তাইওয়ান থেকে উত্তরে রওনা না হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কিছুটা ঘুরে যাওয়া কুরোশিও স্রোতের তীব্রতা এড়াতে সহায়তা করত। এটা বোঝায়, তারা সমুদ্রের স্রোত, মৌসুমি পরিবর্তন এবং আবহাওয়ার প্রভাব সম্পর্কে একটি সূক্ষ্ম, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান অর্জন করেছিল—যা কোনো যন্ত্র ছাড়া অর্জিত হয়।
গবেষকরা শুরুতে ধারণা করেছিলেন, হয়তো প্রাচীন মানুষরা ভেলা ব্যবহার করতেন। কিন্তু পূর্ববর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে দেখা গেছে, কুরোশিও স্রোতের ধাক্কা সহ্য করার মতো ক্ষমতা ভেলার ছিল না। সেটি ধীর এবং দুর্বল; অন্যদিকে কাইফুদের বানানো প্রাচীন নৌকা ছিল অনেক বেশি উপযোগী এবং নির্ভরযোগ্য।
গবেষণাটি কেবল একটি ঐতিহাসিক কল্পনা নয়, এটি একটি ‘প্রায়োগিক প্রত্নতত্ত্ব’ (experimental archaeology) উদ্যোগ। এটি ১৯৪৭ সালের বিখ্যাত ‘কন-টিকি’ অভিযানের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে থর হেইরদাল একইভাবে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, প্রাচীন মানুষরা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে পলিনেশিয়া পর্যন্ত পাড়ি দিতে সক্ষম ছিলেন। একইভাবে, কাইফুর গবেষণা দেখিয়ে দিয়েছে যে, জ্ঞান, সাহস এবং মানসিক দৃঢ়তা থাকলে আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়াও অসাধ্য অনেক কিছুই সম্ভব।
তবে এ যাত্রা সবসময় সফল হতো না বলেই অনুমান। গবেষকরা ধারণা করছেন, যারা হাজার বছর আগে এ পথে যাত্রা করেছিলেন, তাদের অধিকাংশই হয়তো ফিরে আসতে পারেননি। তারা জানতেন না কোন দিকে ফিরলে আবার মূলভূমিতে পৌঁছানো যাবে, কিংবা স্রোতের প্রতিকূলতাকে কীভাবে মোকাবেলা করা যায়। তবু তারা পাড়ি জমিয়েছিলেন অজানার উদ্দেশ্যে। এ সাহসী অভিযাত্রীদের মধ্যে ছিল এক অনন্য ধরণের সংকল্প, যা শুধুমাত্র প্রয়োজন নয়, বরং কৌতূহল ও অভিযানের স্পৃহা থেকেই উৎসারিত হয়েছিল।
এই গবেষণার সবকিছু মিলিয়ে একটি গভীর উপলব্ধি স্পষ্ট হয়ে ওঠে—আমাদের পূর্বপুরুষরা কেবল বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করেননি, বরং তারা জ্ঞান আহরণ করেছেন, পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন, আর অসাধ্যকে সম্ভব করে তুলেছেন। তারা ছিলেন প্রকৃত অর্থেই বিজ্ঞানী, অভিযাত্রী এবং ইতিহাস নির্মাতা। ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাটি আজকের বিজ্ঞানের চোখে অতীতকে নতুন করে চেনার পথ খুলে দিয়েছে।
এই প্রাচীন অভিযাত্রার গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানব ইতিহাস কেবল যন্ত্রের ইতিহাস নয়—মানবিক সাহস, কল্পনা, এবং প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের এক অবিচ্ছিন্ন অন্বেষণ।
আপনার মতামত জানানঃ