মানুষের ইতিহাস যত পুরনো, ছারপোকার সঙ্গ তার চেয়েও পুরনো বললে অতিশয়োক্তি হবে না। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে এক রোমাঞ্চকর তথ্য—আজ থেকে প্রায় ২,৪৫,০০০ বছর আগে, মানুষ যখন গুহাবাসী জীবন যাপন করত, সেই সময় থেকেই ছারপোকার দল মানুষের রক্তের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। সেদিন শুরু হওয়া এই সম্পর্ক আজও টিকে আছে। একে নিছক সংক্রমণ বা যন্ত্রণার ইতিহাস বলা যাবে না; বরং এটি একপ্রকার নির্ভরশীল ও একমুখী ভালোবাসার ইতিহাস—যেখানে ছারপোকা একনিষ্ঠ ভাবে শুধুই মানুষের রক্তের ওপর নির্ভর করে টিকে আছে।
প্রথমে তারা বাদুড়ের রক্ত পান করত। গুহায় থাকা বাদুড় ছিল তাদের একমাত্র খাদ্য উৎস। কিন্তু নিয়ান্ডারথাল মানব যখন সেই গুহায় থাকতে শুরু করে, তখন ছারপোকারা মানুষকেও খাদ্য হিসেবে বেছে নেয়। এখানেই শুরু হয় নতুন এক সম্পর্ক। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ছারপোকারা দুটি ভিন্ন প্রজাতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে—একটি প্রজাতি বাদুড়ের রক্তে অভ্যস্ত থেকে যায়, অপরটি শুধু মানুষের রক্ত পান করে টিকে থাকতে শিখে যায়।
এই বিস্ময়কর তথ্য উঠে এসেছে ডিএনএ-ভিত্তিক জিনোম বিশ্লেষণের মাধ্যমে, যা সম্প্রতি ‘বায়োলজি লেটার্স’ নামক এক গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকরা মনে করেন, ছারপোকা এবং মানুষের এই সম্পর্ক বিবর্তনের ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গবেষণায় জানা গেছে, প্রাচীন যুগে যখন মানুষ গুহা ছেড়ে যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত হচ্ছিল, তখন ছারপোকার সংখ্যা কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু যখন মানুষ ধীরে ধীরে স্থায়ী বসতির দিকে ঝুঁকে, তখনই ফের ছারপোকার সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। বিশেষ করে, আজ থেকে প্রায় ১৩,০০০ বছর আগে, যখন মানুষ কৃষিনির্ভর সভ্যতার দিকে এগিয়ে যায় এবং বসতি গড়ে তোলে, তখন থেকেই ছারপোকাদের বংশবৃদ্ধি বাড়ে দ্রুতহারে। নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে ছারপোকাদের বিস্তারও ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে।
ভার্জিনিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্বান এন্টোমোলজি বিভাগের অধ্যাপক ওয়ারেন বুথ বলেন, ‘‘বাগানে ছারপোকা দেখা যায় না, কারণ তারা মানুষের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।’’ এন্টোমোলজি, যা কীটপতঙ্গ নিয়ে গবেষণার বিজ্ঞান, সেখান থেকেই এই সম্পর্কের গভীরতা অনুধাবন করা সম্ভব হয়েছে। আরেক গবেষক লিন্ডসে মাইলসের মতে, ‘‘মানুষ যতবারই বসতি স্থাপন করেছে, ছারপোকাদের সংখ্যা ততবারই নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। যেন এই দুটি প্রজাতির মধ্যে এক অলিখিত চুক্তি আছে।’’
ছারপোকারা যে শুধু মানুষের রক্ত খায় তাই নয়, আশ্চর্যজনকভাবে তারা অন্য প্রাণীর দিকে তেমন আকৃষ্ট হয়নি। গবেষক ব্রায়ান ভেরেলি বলেন, ‘‘তেলাপোকা বা ইঁদুরের মতো অন্যান্য পরিচিত ঘরোয়া কীটপতঙ্গের তুলনায় ছারপোকার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আরও পুরনো। কিন্তু ছারপোকারা কখনোই মানুষের শরীর থেকে লাফিয়ে অন্য প্রাণীর দিকে ছুটে যায়নি।’’ ভেরেলি আরও বলেন, ‘‘সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হলো, ছারপোকারা কখনোই মানুষের রোগ ছড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেনি। যেমন বিউবোনিক প্লেগ ছড়িয়েছিল ইঁদুরের শরীরের ফ্লিয়া থেকে, ঠিক তেমন কোনো মারাত্মক রোগ ছারপোকার কারণে ঘটেনি।’’
এখানে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাই—ছারপোকা ও মানুষের সম্পর্ক কেবল একটি বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার নাম নয়, বরং এটি মানব ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক দীর্ঘ বিবর্তনের চিত্র। গুহামানব থেকে আধুনিক অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা—মানুষ যতই বদলাক, ছারপোকা তার সঙ্গ ছাড়েনি। তাদের রক্তের প্রতি একনিষ্ঠতা, অন্য প্রাণীর প্রতি অনাগ্রহ এবং মানুষের সঙ্গে দীর্ঘকালীন সহাবস্থান একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করার সুযোগ এনে দিয়েছে।
এই গবেষণার আলোকে ভবিষ্যতে আরও গভীরভাবে বোঝা সম্ভব হবে যে, কীভাবে মানুষের জীবনযাত্রা, পরিবেশ, ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কিছু কীটপতঙ্গও পাল্লা দিয়ে নিজেদের বিবর্তিত করেছে এবং মানুষের ছায়াতলে টিকে থেকেছে। কখনো তারা বন্ধু নয়, শত্রুও নয়—তবুও মানুষের পাশে থেকে গেছে চুপিচুপি। হয়তো ইতিহাসের সবচেয়ে অদ্ভুত প্রেমকাহিনি এটি—একটি একমুখী ভালোবাসা, যা শুরু হয়েছিল গুহায়, এবং আজও শেষ হয়নি।
আপনার মতামত জানানঃ