মানবসভ্যতা উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে আজ যে অবস্থানে এসে পৌঁছেছে, তাতে কেবল মানুষেরই অবদান ছিল, এমনটা দাবি করলে সেইসব অবলা জীবজন্তুদের প্রতি ভীষণ অবিচার করা হবে, যাদের অবদান মোটেই ফেলনা ছিল না। সেই বন্য কুকুর-বিড়াল থেকে শুরু করে গরু, ছাগল, ভেড়া, কিংবা উট, গাধা, মোষ, সকল প্রজাতির পশুই নিজ নিজ অবস্থান থেকে মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে অবদান রেখে গেছে।
কিন্তু যদি আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, পৃথিবীর ইতিহাসে যত পশু আছে বা ছিল, তার মধ্যে মানবসভ্যতার উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি অবদান কোন পশুটির, একটু কি থতমত খেয়ে যাবেন না? নিশ্চয়ই যাবেন। কিন্তু সামলে নিয়ে যে নামটি আওড়াবেন, শতকরা নব্বই ভাগ সম্ভাবনা সেটি হবে ঘোড়া। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে ভার বহন, দূরত্বকে জয় কিংবা যুদ্ধ বিগ্রহে অগ্রণী ভূমিকা পালন, কোথায় নেই ঘোড়ার অবদান! একটু গভীরে চিন্তা করে দেখলে বোঝা যাবে, মানুষকে সত্যিকারের মানুষ করে তুলতে ঘোড়া চেষ্টার কোনো কমতি রাখেনি।
এখন আপনার কৌতূহলী মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, ঠিক কবে থেকে মানুষের সাথে ঘোড়ার এমন সখ্যতা? কবে থেকে ঘোড়া বন ছেড়ে মনুষ্য সৃষ্ট আস্তাবলে রাত কাটাতে শুরু করল? আর কীভাবেই বা মানবসভ্যতার উন্নয়নের সূচক টেনে উপরে তুলতে ঘোড়া অবদান রাখল? এই লেখার মাধ্যমে আমরা সেইসব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজব।
পৃথিবীতে ঘোড়ার আগমন সেই ইয়োসিন-ইপক যুগে, অর্থাৎ ৫৫.৮ থেকে ৩৩.৯ মিলিয়ন বছর আগে। তখন উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে ৪.২ থেকে ৫ হাত (১.৪ থেকে ১.৭ ফুট) পর্যন্ত লম্বা এক ধরনের জন্তু দেখা যেত, যাকে ঘোড়ার আদি পুরুষ হিসেবে ধরা হয়। তবে মানুষের সাথে ঘোড়ার যোগসূত্রের প্রথম হদিস পাওয়া যায় অনেক পরে, খ্রিষ্টপূর্ব ৩০,০০০ অব্দে। প্রাচীন প্রস্তরযুগের আদিমানবদের গুহাচিত্রে ঘোড়ার ছবি আবিষ্কৃত হয়। তখনও অবশ্য মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হয়নি ঘোড়ার। বনে-জঙ্গলে ঘুড়ে বেড়াত তারা, আর মানুষ মাঝেসাঝে তাদের শিকার করত মাংসের লোভে।
প্রথম মানুষের কাছে ঘোড়ার পোষ মানার নিদর্শন আমরা খুঁজে পাই ইউরেশিয়ার স্তেপ অঞ্চলের ইতিহাসে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩,৫০০ অব্দের দিকে বর্তমান কাজাখাস্তানের আকমোলা প্রদেশের প্রাচীন বোটাই সভ্যতায় পালন শুরু হয় ঘোড়া। সেই সভ্যতার মানুষ ঘোড়া দিয়ে ঠিক কী কী করত সে সম্পর্কে বিশদে জানা না গেলেও, ধারণা করা হয়, ঘোড়ার দুধ ও মাংসই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য।
ঘোড়াকে দিয়ে কাজ করানোর শুরু সম্ভবত মেসোপটেমিয়ায়। এই অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত খ্রিস্টপূর্ব ২,০০০ অব্দ সময়কালের টেরাকোটায় ঘোড়া দিয়ে রথ টানানোর দৃশ্য দেখা যায়। এছাড়া খ্রিস্টপূর্ব ২,০০০-১,৮০০ অব্দে ওই অঞ্চলে সরাসরি ঘোড়ার পিঠে চড়ারও সূচনা হয়। আর মিশরে খ্রিস্টপূর্ব ১,৬০০-১,৪০০ অব্দের কবরের উপর আঁকা চিত্রকর্ম থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে, সেখানেও তখনকার মানুষ ঘোড়ার পিঠে চড়তে আরম্ভ করেছিল।
ঘোড়া সম্বন্ধীয় প্রথম লিখিত নমুনার জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ১,৪০০ অব্দে। সেখানে রথ টানার উপযোগী ঘোড়াকে কীভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে এ ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এছাড়া খ্রিস্টপূর্ব ৩৬০ অব্দের দিকে এথেন্সের গ্রিক দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, সৈন্য জেনোফোন, যিনি ছিলেন সক্রেটিসের একজন ছাত্রও বটে, রচনা করেন ঘোড়া নিয়ে বিখ্যাত বই ‘দ্য আর্ট অব হর্সম্যানশিপ’। এমনকি আজকের দিনেও বইটি খুবই প্রাসঙ্গিক, যেখানে ঘোড়ায় চড়ার নানাবিধ কৌশল থেকে শুরু করে ঘোড়ার মনস্তত্ত্ব এবং কীভাবে ঘোড়ার পরিচর্চা করতে হবে, এই সকল বিষয়েই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
ঘোড়াকে পোষ মানানোর আগ পর্যন্ত যেকোনো জাতির বিচরণের ক্ষেত্রই খুব সীমাবদ্ধ ছিল। কৃষিকাজে যতই উন্নতি হোক না কেন, আর তার মাধ্যমে সভ্যতার গোড়াপত্তন ঘটুক না কেন, মানুষ কোনো লম্বা পথ অতিক্রমের সাহস দেখানো তো দূরে থাক, এমনকি স্বপ্ন দেখতেও ভয় পেত। কেননা মানুষের পক্ষে পায়ে হেঁটে কতদূরেই বা যাওয়া সম্ভব! কিন্তু যখন মানুষ ঘোড়ার সাথে সখ্যতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হলো, তখন থেকেই মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সীমা ছাড়িয়ে গেল।
ঘোড়ার ক্ষীপ্র গতি আর অভাবনীয় শক্তির উপর ভর করে মানুষ দূরকে জয়ের পথে পা বাড়াল। বদলে গেল মানুষের পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও। দূরত্ব জয় তো ছিলই, এর পাশাপাশি কৃষিকাজ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ব্যবসা, ক্রীড়াক্ষেত্র সবখানেই ঘোড়া হয়ে উঠল মানুষের বিশ্বস্ত বন্ধু ও সহচর।
ঘোড়ার আগমনের পূর্বেও মানুষ গরু দিয়ে ফসলী জমিতে লাঙল চালাতো। কিন্তু সেটি ছিল খুবই সময়সাপেক্ষ কাজ। গরু অত্যন্ত ধীরগতির প্রাণী। পাশাপাশি গরু প্রচন্ড আলসেও। একটানা বেশিক্ষণ কাজ করতে পারতো না। অল্পতেই হাঁপিয়ে যেত, নয়তো একটু পর পর খাওয়াতে হতো। তখন তাকে খাওয়া-দাওয়া করে শরীরে শক্তি ফিরিয়ে আনতে হতো। কিন্তু খাওয়ার সাথে সাথেই আবার সে কাজে ফিরতে পারত না। খাওয়ার পর আবার কিছুক্ষণ তাকে বিশ্রাম নিতে হতো। ঘোড়ার বেলায় এমন কোনো ঝক্কি ছিল না। খাওয়ার পরই সে আবার কাজ শুরু করে দিত প্রচন্ড দ্রুতগতিতে। ফলে সময়ের কাজ সময়ে শেষ করা নিয়ে মানুষকে আর চিন্তায় থাকতে হতো না।
তাছাড়া জমির কাজ শেষে উৎপন্ন ফসল বহন করা এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্যও ঘোড়াকে ব্যবহার করা যেত। ঘোড়া কাজে লাগত অন্যান্য মালামাল পরিবহনের কাজেও। ধরুন, একজন গড়পড়তা মানুষ হয়তো একবারে ৫০ পাউন্ড বোঝা বহন করতে পারত। একটি ঘোড়া সেখানে পারত ২০০ পাউন্ড। আর বুদ্ধি করে যদি ঘোড়াকে কোনো চাকাওয়ালা বাহনের সাথে জুড়ে দেয়া হতো, তাহলেই কেল্লাফতে! এবার সেই ঘোড়া বহন করতে পারত ১,০০০ থেকে ২,০০০ পাউন্ড বোঝাও!
ঘোড়ার আগমনে উপকৃত কেবল কৃষক ও ব্যবসায়ীরাই হয়নি, হয়েছিল রাখাল বালকরাও। তাদের জীবনে অভূতপূর্ব স্বাচ্ছন্দ্য বয়ে এনেছিল ঘোড়া। ছোট্ট একটি উদাহরণের মাধ্যমেই বিষয়টিকে পরিষ্কার করা যাবে। একজন রাখাল ও একটি কুকুর যেখানে মাত্র ২০০টি ভেড়া চড়াতে পারতো, সেখানে একজন রাখাল, একটি কুকুরের সাথে একটি ঘোড়া যোগ করলেই ৫০০টি ভেড়া চরানো যেত।
মানুষের স্বাভাবিক হাঁটার গতি ছিল ঘণ্টায় ৪ মাইল করে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা হেঁটেই মানুষের শক্তি শেষ হয়ে যেত, আর আগে বাড়তে পারত না। অন্যদিকে ঘোড়াও স্বাভাবিকভাবে এই গতিতেই হাঁটত, তবে অনেক লম্বা সময় পর্যন্ত। আবার গতি একটু বাড়ালেই ঘণ্টায় ৮ মাইল পর্যন্ত যেতে পারত। আর যদি দূরত্ব খুব বেশি না হয়, তাহলে ঘোড়া দৌড়ে ঘন্টায় ৩৫ মাইলও চলে যেতে পারত। সবমিলিয়ে স্বাভাবিক গতিতে দিনে ৮ ঘণ্টা হেঁটে ঘোড়া ৩২ মাইল এবং দৌড়ে ১০০ মাইল পর্যন্ত অতিক্রম করতে পারত।
তাহলে বুঝতেই পারছেন, ঘোড়াকে পোষ মানানোর ফলে বাস্তবিকই দূরত্ব জয় করা কত সহজ হয়ে গিয়েছিল মানুষের জন্য। দৈনিক একটানা হেঁটে যে মানুষটি ২০ মাইলও অতিক্রম করতে পারত না, ঘোড়ায় চড়ে সেও ১০০ মাইল অতিক্রম করা শুরু করলো। ফলে মানুষকে এখন আর নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হলো না। তারা বেরিয়ে পড়তে শুরু করল অজানাকে জানার উদ্দেশ্য এবং তা করতে গিয়ে তারা দেখা গেলো, তাদের বাসস্থানের কিছু দূরেই একইরকম জাতীয়তার আরও বিভিন্ন গোষ্ঠীর বাস। এতদিন তারা ছাড়া ছাড়া ভাবে থেকেছে। এবার যখন তাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হয়েই গিয়েছে, গোষ্ঠীগুলো আর ছন্নছাড়া না হয়ে একত্রে বাস করতে শুরু করলো। এর মাধ্যমে সভ্যতা আরও শক্তিশালী হলো, সভ্যতার ভিতও মজবুত হলো।
আবার ঘোড়ার সুবাদেই কিছু কিছু দুঃসাহসী মানুষ কেবল নিজ অঞ্চলের আশেপাশে ঘুরে বেড়িয়েই সন্তুষ্ট থাকল না, তারা চলে যেতে থাকল আরও দূর থেকে দূরে। এভাবে তারা পৌঁছাতে থাকল এমন অজানা কোনো দেশে, যার অস্তিত্ব সম্পর্কে পূর্বসূরীরা কেউ হয়তো অবগতই ছিল না। কিংবা সেদেশের ভাষা হয়তো একেবারেই ভিন্ন। প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ সেসব ভাষা শিখে নিল, তাদেরকেও নিজের মুখের বুলি শিখিয়ে দিল। এভাবে আদান-প্রদান ঘটল ভাষা ও সংস্কৃতির।
ভাষাগত অভিন্নতা চলে এলে বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হলো। তখন এক দেশের সাথে অন্য দেশের ব্যবসায়িক বিনিময় ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক সৃষ্টিরও পথ সুগম হলো। এক দেশ হয়তো মসলার জোগান দিল, বিনিময়ে নিজেরা নিল রবিশস্য। এভাবেই সব দেশই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে লাগল। একটি তথ্য জেনে অনেকেই অবাক হবেন, ১৮৮০ সালে কলকাতার ট্রামগাড়িকে বয়ে নিয়ে যেতো এই ঘোড়ারাই। সেখানেই শেষ নয়। সম্রাট শের শাহের আমলে চিঠিপত্র বিলি করা হতো এই ঘোড়ার পিঠে চেপেই!
আপনার মতামত জানানঃ