ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) গত শুক্রবার নিজেদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সের (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে লিখেছে, ‘যাচনা ন্যাহি, আব রণ হোগ্যা’। এর আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায়, ‘অনুরোধ নয়, এবার যুদ্ধ হবে’। এই পঙ্ক্তির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিমানবাহিনীর জাম্পস্যুট পরা একটি ছবিও যুক্ত করা হয়েছে।
উল্লিখিত পঙ্ক্তিটি বিখ্যাত হিন্দি কবি রামধারী সিং দিনকরের একটি কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি যখন পোস্ট করা হয়, তখন উত্তেজনা এমন পর্যায়ে পৌঁছে ছিল যে মনে হচ্ছিল, ভারত-পাকিস্তান একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।
বিজেপির ওই পোস্টের ২৪ ঘণ্টার একটু বেশি সময় পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ দেশটির অন্যান্য কর্মকর্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে বলে ঘোষণা দেন। ফলে সংঘাত হঠাৎ থেমে যায়।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর দুই দেশের বেশির ভাগ মানুষ, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করেন। কিন্তু উগ্রবাদী হিন্দুরা যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় খুশি হতে পারেননি। এই ঘোষণায় তাঁরা হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
হিন্দুত্ববাদী কর্মী, সরকারপন্থী সংবাদমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, এমনকি বিজেপি নেতারাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, শক্তিমত্তার দিকে এগিয়ে থেকেও যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে ভারত আত্মসমর্পণ করেছে।
বিজেপির সমর্থক শেফালি বৈদ্য এক্সে লেখেন, ‘স্পষ্টতই এগিয়ে থাকার পরও যখন আপনি সরে দাঁড়ান, তা কিছুটা হতাশাজনক মনে হয়।’ তবে দেশের নেতারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটার ওপর নিজের ভরসা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
যুদ্ধবিরতির কারণে বিজেপির অন্য সমর্থকেরা আরও কঠোরভাবে মোদি সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চেয়েছেন। বিজেপির ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত শক্তি সিং প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ট্যাগ করে এক্সে লিখেছেন, পাকিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যা করেছিল, দাউদ ইব্রাহিম ও হাফিজ সাঈদের বিরুদ্ধে ভারত সেই ধরনের কিছু করতে পারেনি। তাঁর মতে, ‘যতক্ষণ পর্যস্ত এসব জঙ্গি জীবিত আছে, ততক্ষণ যুদ্ধবিরতির কোনো অর্থ হয় না।’
গুয়াহাটিভিত্তিক ব্যবসায়ী ও বিজেপির সদস্য মুন তালুকদার বলেন, ‘হঠাৎ যুদ্ধবিরতি ভারতের ভূখণ্ডে জঙ্গি পাঠানো থেকে পাকিস্তানকে থামাতে পারবে না।’ মুন একসময় অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের নেতা ছিলেন।
৩০ বছর বয়সী মুন বলেন, ‘ভারতের উচিত ছিল পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর দখল করে নেওয়া। যতক্ষণ না আমরা সেই কাশ্মীর দখল করছি, ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ চলতেই থাকবে। যদি যুদ্ধবিরতি না হতো এবং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর দখল করা যেত, তাহলে ভারত প্রমাণ করতে পারত যে আমরা দুর্বল দেশ নই। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো আমরাও বিশ্বশক্তিগুলোর সমতুল্য।’
যুদ্ধবিরতির পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত ছিল। যুদ্ধবিরতির ঘোষণাই দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই বিষয়টি বিজেপির সমর্থকদের প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করেছে।
সাংবাদিক থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া স্বপন দাশগুপ্ত এক্সে লিখেছেন, ‘এই যুদ্ধবিরতি/ “সমঝোতা” ভারতে ভালোভাবে গ্রহণ করা হয়নি। কারণ…ট্রাম্প হঠাৎ করেই এই ঘোষণা দিয়েছেন। মনে হলো যেন, তিনি ধুম করে কোনো জায়গা থেকে আবির্ভূত হয়ে নিজের রায় জানিয়ে দিলেন।’ স্বপন বিজেপির জাতীয় কার্যনির্বাহী সদস্য।
যুদ্ধবিরতিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের ভূমিকার প্রশংসা করেছে পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান বন্ধে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কথা স্বীকার করেনি ভারত।
যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স (বাঁয়ে) ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে, ২১ এপ্রিল ২০২৫ছবি: রয়টার্স
তা সত্ত্বেও ট্রাম্প আরেক ধাপ এগিয়ে গেছেন। গত রোববার ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ‘আমার পরবর্তী কাজ হলো ভারত ও পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে কাশ্মীর বিষয়ে একটি “সমাধান” বের করার চেষ্টা করা।’ ট্রাম্পের এই মন্তব্য অনেক ভারতীয়কে ক্ষুব্ধ করেছে। তাঁরা মনে করে, ওয়াশিংটন এই অঞ্চলে হস্তক্ষেপ ক্রমে বাড়াচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন।
রিপাবলিক মিডিয়া নেটওয়ার্কের প্রধান সম্পাদক অর্ণব গোস্বামী ট্রাম্পের ‘অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ’ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। রাগান্বিত কণ্ঠে এক প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘তাঁর (ট্রাম্পের) মাঠের বাস্তবতা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। এখানে কী ঘটছে, সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।’
অর্ণব গোস্বামী আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, এটা (কাশ্মীর বিষয়) তাঁর আয়ত্তের বাইরে। এটা ট্রাম্পের স্বভাবসুলভ অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ। আমি এটা মানি না। আমরা এটা মিটমাট করব।’
মোদি সরকার আগের আগ্রাসী অবস্থান থেকে সরে এসেছে বলে যাঁরা মনে করছেন, তাঁদের অনেকে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির ওপরও ক্ষোভ ঝাড়তে ভুল করেননি না। তিনি ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন করে আসছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা মিশ্রির পুরোনো পারিবারিক ছবি এবং তাঁর মেয়ের পেশাগত জীবনের বিবরণ ছড়িয়ে দেন। তাঁর মেয়ের সম্ভাব্য রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিদ্রূপ (ট্রলিং) ও কটাক্ষ শুরু করেন। এসব আচরণ একটা সময় খুব ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। একপর্যায়ে মিশ্রি তাঁর এক্স প্রোফাইলের গোপনীয়তা সেটিংস পরিবর্তন করতে বাধ্য হন।
একটি বিশেষ ধরনের প্রত্যাশার পরাজয়ই ছিল হিন্দু দক্ষিণপন্থীদের ক্ষোভের মূল কারণ। তাঁরা মনে করতেন, নরেন্দ্র মোদির ‘বলিষ্ঠ’ সরকার ‘পাকিস্তান সমস্যার’ একটি ‘চূড়ান্ত সমাধান’ এনে দিতে সক্ষম।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) ঘনিষ্ঠ ছাত্রসংগঠন পশ্চিমবঙ্গ ছাত্রসমাজের আহ্বায়ক সায়ন লাহিড়ী গত শনিবার স্ক্রল ডট ইনকে বলেন, ‘আমি একেবারেই অসন্তুষ্ট। কারণ, সাধারণ হিন্দুসমাজ একটা সহজ জিনিস চেয়েছিল, তারা জিহাদবাদ নির্মূলের জন্য একটি চূড়ান্ত সমাধান প্রত্যাশা করেছিল।’
পশ্চিমবঙ্গ ছাত্রসমাজ গত আগস্টে কলকাতার আর জি কর হাসপাতালে এক জুনিয়র চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সচিবালয়ের দিকে একটি সহিংস প্রতিবাদ মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিল। বিজেপি ও আরএসএস তাদের সহযোগিতা করেছিল।
৩১ বছর বয়সী সায়ন লাহিড়ী বিজেপির বিরুদ্ধে ‘যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কাছে মাথা নোয়ানোর’ অভিযোগ এনেছেন। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানকে বিশ্বমানচিত্র থেকে মুছে ফেলাই ছিল দেশপ্রেমী সনাতনী হিন্দুদের দাবি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখনো পেহেলগাম হত্যাযজ্ঞের দায়ীদের খুঁজে বের করতে পারিনি।’
গুয়াহাটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের এক সদস্য স্ক্রল ডট ইনকে বলেন, মাঠপর্যায়ের অনেক কর্মীই হতাশ। তাঁর মতে, ‘আমরা আমাদের পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করে শক্তি দেখাতে পারতাম।’
আরএসএসের এই কর্মী বলেন, ‘ইয়েহ দিল মাঙ্গে মোর।’ মানে, এই হৃদয় আরও চায়।
আপনার মতামত জানানঃ