পৃথিবীর অভ্যন্তরে, আফ্রিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরের সীমানায়, মাউন্ট এভারেস্টের চেয়ে ১০০ গুণ উঁচু দু’টি পাহাড় রয়েছে। এই আবিষ্কারটি সম্প্রতি ‘Nature’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮.৮ কিলোমিটার উঁচু মাউন্ট এভারেস্টের তুলনায়, এই পাহাড়গুলো প্রায় ১,০০০ কিলোমিটার উঁচু এবং পৃথিবীর অভ্যন্তরে গভীরে রয়েছে।
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই পাহাড়গুলোর বয়স অন্তত ৫০ কোটি বছর, তবে এগুলো পৃথিবী গঠনের প্রায় চার বিলিয়ন বছর আগেও তৈরি হতে পারে। গবেষণার প্রধান, সিসমোলজিস্ট এবং নেদারল্যান্ডসের উট্রেক্ট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আরওয়েন ডিউস বলেছেন, ‘কেউ জানে না এই পাহাড়গুলো কীভাবে তৈরি হয়েছে বা এগুলো সাময়িক কোনো ঘটনা, নাকি লক্ষ বা কোটি বছর ধরে এভাবেই রয়েছে।’
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এই বিশাল কাঠামো দু’টি পৃথিবীর ভূত্বক ও ম্যান্টেলের (ম্যাগমা স্তর) সংযোগস্থলে রয়েছে। এই এলাকাগুলোকে “Large Low Seismic Velocity Provinces” (LLSVPs) বলা হচ্ছে। আফ্রিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে অবস্থিত এই স্থানগুলো ঘিরে আছে একটি বিশাল ‘টেকটনিক প্লেটের সমাধিক্ষেত্র’, যেখানে সাবডাকশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এক টেকটনিক প্লেট আরেকটির নিচে তলিয়ে গিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় টেকটনিক প্লেটগুলো পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার গভীরে পৌঁছে যায়।
ড. ডিউস জানান, ভূমিকম্প থেকে সৃষ্টি হওয়া শকওয়েভ বা ভূকম্পন-তরঙ্গের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই ম্যান্টেলের গভীরে থাকা এই অজানা কাঠামোর অস্তিত্ব টের পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি, ভূকম্পন তরঙ্গ সেখানে ধীর হয়ে যায়। এই তথ্য থেকেই এই পাহাড়ের অবস্থান জানা গেছে।’
গবেষণার সহ-গবেষক সুজানিয়া তলাভেরা-সোজা জানান, ভূকম্পন তরঙ্গ যখন পৃথিবীর গভীরে যায়, তখন তারা শক্তি হারায়। তবে LLSVP এলাকায় তরঙ্গগুলো শক্তি তেমন হারায়নি। বরং সেখানকার শব্দ ছিল বেশ তীক্ষ্ণ। তিনি বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, গরম এলাকায় তরঙ্গ বেশি দুর্বল হবে। তবে এখানে তেমন কিছু দেখিনি। বরং টেকটনিক প্লেটের ঠান্ডা ‘সমাধিক্ষেত্রে’ তরঙ্গ অনেক বেশি শক্তি হারিয়েছে।’
গবেষণায় আরও দেখা গিয়েছে, এই পাহাড়গুলো আশপাশের প্লেটের চেয়ে অনেক বেশি পুরনো। এগুলোর গঠন বৃহত্তর এবং খনিজ দানা অনেক বড় হওয়ার কারণে সিসমিক তরঙ্গ কম শক্তি শোষণ করে। সুজানিয়া বলেন, ‘খনিজগুলি বড় হওয়ার মানে হল, এটি একদিনে তৈরি হয়নি। এটি প্রমাণ করে যে, LLSVP এলাকা আশপাশের টেকটনিক প্লেটের চেয়ে অনেক পুরনো।’
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছে, তাঁদের অনেক দিনেরই সন্দেহ ছিল, সমুদ্রের তলায় এ ধরনের পর্বত লুকিয়ে থাকতে পারে। যদিও কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ ছিল না তাঁদের হাতে। শেষ পর্যন্ত ভূমিকম্প এবং সিসমিক শকওয়েভের চরিত্র বিশ্লেষণ করে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
এই দুই শৃঙ্গের বয়স কত হতে পারে? বিজ্ঞানীদের অনুমান, ন্যূনতম পক্ষে ৫০ কোটি বছর। তবে এমনও হতে পারে, এগুলির বয়স পৃথিবীর বয়সের সমান। মানে, প্রায় ৪০০ কোটি বছর। সে তুলনায়, এভারেস্টকে ‘নেহাত শিশু’ ঠাকুরদা বলা যেতে পারে। কারণ এদের মাউন্ট এভারেস্টের বয়স ‘মাত্র’ ৬ কোটি বছর।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘আমাদের ভূপৃষ্ঠের নিচের বিশাল অংশ এখনো উত্তপ্ত ও গলিত অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে ঠান্ডা হচ্ছে। এতে অনেক কঠিন কাঠামো ভবিষ্যতেও তৈরি হতে পারে। নতুন সন্ধান পাওয়া পর্বতগুলো ভূপৃষ্ঠের নিচে টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে নতুন কাঠামো তৈরির বিষয়ে জানার সুযোগ করে দেবে।’
আপনার মতামত জানানঃ