‘বিস্ময়কর’ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অনেক বছর ধরে বাহবা পেয়েছে বাংলাদেশের বিগত সরকার। ২০০৯ সাল থেকে এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা; যিনি নিজেকে এই প্রবৃদ্ধির মূল কারিগর দাবি করতেন। সরকারি পরিসংখ্যানের ফলাফলও তার এই দাবিকে বৈধতা দিত; মহামারির আগের দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ শতাংশ হয়েছিল, প্রবৃদ্ধির এই হার ছিল চীনের সাথে তুলনীয়।
‘বিস্ময়কর’ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অনেক বছর ধরে বাহবা পেয়েছে বাংলাদেশের বিগত সরকার। ২০০৯ সাল থেকে এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা; যিনি নিজেকে এই প্রবৃদ্ধির মূল কারিগর দাবি করতেন। সরকারি পরিসংখ্যানের ফলাফলও তার এই দাবিকে বৈধতা দিত; কোভিড মহামারির আগের দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ শতাংশ হয়েছিল, প্রবৃদ্ধির এই হার ছিল চীনের সাথে তুলনীয়। কিন্তু, আর সবের মতো এ বয়ানও ধসে পড়েছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনার পতন হয়েছে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা ও দুর্নীতির চিত্র যাচাইয়ে জাতীয় শ্বেতপত্র কমিটি গঠন করে। এই মাসের শুরুতে শ্বেতপত্রটি প্রকাশ করা হয়েছে, যা হাসিনার উন্নয়নের দাবিগুলো খণ্ডন করেছে। উন্মোচন করেছে হাসিনার অর্থনৈতিক লিগ্যাসি প্রতিষ্ঠার যত প্রয়াস।
শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্প ছিল অতিরঞ্জিত, উন্নয়ন জাহির করতে বাড়িয়ে দেখানো হতো মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। যার প্রধান হচ্ছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো এবং নাগরিক প্ল্যাটফর্ম-এর আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বাংলাদেশের অর্থনীতির সব খাত যাচাই করবার দায়িত্ব পান তাঁরা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিমাপে তাঁরা বিশ্বব্যাংকের একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন; যেখানে রাতের বেলায় আলোর তীব্রতার হিসাব করে প্রবৃদ্ধির নতুন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে অর্থনীতির আকার বেড়েছিল মাত্র ৩ শতাংশ, যদিও তৎকালীন সরকার দাবি করেছিল ৭ শতাংশ। দেশের ভেতরে উন্নয়নের মিথ্যা বয়ান প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে এই প্রোপাগান্ডা চালানো হয় বলে শ্বেতপত্রে অভিযোগ করা হয়েছে।
তবে শ্বেতপত্রে দুর্নীতির যেসব চিত্র উঠে এসেছে সেটিই সবচেয়ে উদ্বেগজনক। ২৩৪ পাতার এই শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে যে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৩৪ কোটি ডলার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। বছরে পাচার হয়েছে জিডিপির প্রায় ৩.৪ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ-সম্পদ। পুঁজিবাজারে জালিয়াতি, মাদক চোরাচালান, ঋণ খেলাপি, ঘুষ থেকে শুরু করে বিবিধ অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জিত হয় এসব সম্পদ। দুর্নীতির একটা বড় অংশ হয়েছে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে; প্রকল্প ব্যয় বেশি দেখিয়ে এবং দফায় দফায় ব্যয় বাড়িয়ে– অতিরিক্ত অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। শ্বেতপত্র কমিটি জানিয়েছে, রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের দালাল ও মধ্যস্ততাকারী দুর্নীতির প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন।
শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় বলেন, বাংলাদেশে দুর্নীতির ঘটনা নতুন নয়— তবে এত ব্যাপক ও সর্বব্যাপী হতে আমরা আগে দেখিনি। বছরের পর বছর ধরে অকার্যকর রাজনীতির কারণে দুর্নীতি শেকড় গেড়ে বসেছে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির সহসাই কোনো নিরাময় বের করা যাবে না। সমাধানের পথও জটিল; কারণ প্রতিটি স্তরের সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতির অংশ ছিলেন, সংস্কার বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারকে বাধ্য হয়ে তাঁদেরই ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তাই স্বাধীন পরিসংখ্যান ব্যুরো ও অর্থনৈতিক কমিশন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে শ্বেতপত্রে।
অবশ্য আরও অনেক কিছু জরুরি-ভিত্তিতে করার আছে। মূল্যস্ফীতি উচ্চ হারে হচ্ছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পরিবেশে ধস নেমেছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে। গত ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস সংশোধন করে কমিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বিশ্বব্যাংক বলেছে, গ্রামের অনেক পরিবার আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ যদি এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করতে পারে– তাহলে সেটা হবে সত্যিকারের ‘মিরাকল’
আপনার মতামত জানানঃ