সিরিয়া নিয়ে ইসরায়েলের মাথাব্যথা অনেক দিনের। ইসরায়েল ২০১৩ সাল থেকে সিরিয়ায় ২৫০টিরও বেশি বিমান হামলা চালিয়েছে। এই হামলাগুলো মূলত ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া এবং সিরিয়ার সামরিক স্থাপনার ওপর চালানো হয়েছে, যাতে ইরান সিরিয়ার ভেতর শক্তি বৃদ্ধি করতে না পারে। ১৯৮১ সালে দখলকৃত গোলান মালভূমিতে ইসরায়েল নিজেদের অবস্থান আরও দৃঢ় করেছে এবং সেখানে নজরদারি বৃদ্ধি করেছে।
ইসরায়েলের বিমান হামলার অন্যতম লক্ষ্য ছিল সিরিয়ার ভেতর দিয়ে লেবাননের হিজবুল্লাহর কাছে উন্নত অস্ত্র পৌঁছানোর পথ বন্ধ করা। ইসরায়েল সিরিয়ার সীমান্তে বাফার জোন বা সুরক্ষা অঞ্চল সম্প্রসারণ করেছে, যাতে ইরান ও তার মিত্রদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা যায়।
ইসরায়েলের এই পদক্ষেপগুলো ১৯৭৪ সালের Disengagement Agreement লঙ্ঘন করেছে, যা সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে নির্ধারিত সীমান্ত রক্ষা করতে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করেছিল। ইসরায়েল তাদের পদক্ষেপগুলোকে আত্মরক্ষামূলক বলে দাবি করলেও, এই আক্রমণ এবং বাফার জোনের সম্প্রসারণ মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনা সৃষ্টি করেছে।
ইসরায়েলের সিরিয়ার ভূখণ্ডে, বিশেষ করে গোলান মালভূমির বাফার জোনে অনুপ্রবেশের দুটি প্রধান উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, তার নিরাপত্তা কৌশল। ইসরায়েলের প্রধান উদ্বেগ তার উত্তর সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠী যেমন হিজবুল্লাহ এবং সিরিয়ার অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে ইসরায়েল তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। সিরিয়ায় ভেতরে যা–ই ঘটবে, তাকে ইসরায়েল কোনো না কোনোভাবে তার নিজের গায়ে টেনে নিয়ে পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। আর নিজের এই পদক্ষেপকে সে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দেখাবে।
দ্বিতীয়ত, বাফার জোন সম্প্রসারণ। বাফার জোনের বিস্তার করে ইসরায়েল তার কৌশলগত গভীরতা বাড়াতে চায়। তবে এই নীতি, ‘বাফার জোন রক্ষা করতে নতুন বাফার জোন’ তৈরি করে। এর ফলে এই নীতি একটি চক্রে পরিণত হতে পারে। এবং তা হয়েও আসছে। এর মাধ্যমে ইসরায়েল ক্রমাগত নতুন ভূখণ্ড দখলের দিকে এগিয়ে যায়।
ইসরায়েলের ডানপন্থী মন্ত্রীরা, যেমন বেজালেল স্মোত্রিচ, ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক বর্ণনার ভিত্তিতে ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ ধারণার পক্ষে বয়ান তৈরি করতে চান। তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে গোলান মালভূমির বাইরেও, এমনকি দামেস্ক পর্যন্ত ইসরায়েলের সীমান্ত সম্প্রসারণের দাবি করে। তবে এই দাবিগুলো যতটা আদর্শগত ততটা বাস্তব নয়।
স্মোত্রিচের এই ধারণা ডানপন্থী ইসরায়েলিদের একটি অংশের মধ্যে জনপ্রিয়। তবে তা সাধারণ ইসরায়েলি জনগণ এবং মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন পায়নি। অর্থমন্ত্রী হিসেবে স্মোত্রিচের অবস্থান এবং নেতানিয়াহুর জোটে তার প্রভাব এই মতামতকে একটি প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে। তবে তা এখনো ইসরায়েলের সরকারি নীতিতে পরিণত হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার একটি জটিল আঞ্চলিক পরিস্থিতির মধ্যে নিজেদের হিসাব-নিকাশ করছে। সিরিয়াতে নতুন পরিস্থিতিতে নেতানিয়হুর প্রধান লক্ষ্য হবে অস্থিতিশীলতার সুযোগ গ্রহণ। আসাদ সরকার পতন এবং আঞ্চলিক অস্থিরতা ইসরায়েলের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এর মধ্য দিয়ে সে এই অঞ্চলে যে ইরানি প্রভাব ছিল, তা শেষ করে নতুন করে নিজেদের মতো করে আঞ্চলিক ভারসাম্য ঢেলে সাজাবে।
আরও যে সুবিধা ইসরায়েল নেবে, তা হলো রাজনৈতিক মনোযোগ সরিয়ে দেওয়া। নেতানিয়াহু ইসরায়েলের ভেতরে বেকায়দায় আছেন রাজনৈতিকভাবে। তাঁর এবং তাঁর ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। এগুলোর বিচার শুরু করবার দাবি আছে। সিরিয়ার নতুন পরিস্থিতিতে গাজা ও লেবাননের সমস্যাগুলো থেকেও নেতানিয়াহু নিজের বিরোধীদের মনোযোগ অন্য দিকে নিয়ে যেতে পারবেন সহজেই।
সিরিয়ার অতিরিক্ত ভূখণ্ড দখল করার মাধ্যমে ইসরায়েল ১৯৭৪ সালের চুক্তি লঙ্ঘন করছে। এর ফলে সার্বভৌমত্বের বিষয়ে আন্তর্জাতিক যে সংজ্ঞা ও মান আছে, তা–ও লঙ্ঘিত হলো। আর এর ফলে কয়েকটি মূল বিষয় ধরা পড়ে। যেমন জাতিসংঘের দুর্বলতা। ইসরায়েলের একতরফা পদক্ষেপে বাফার জোনে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের উপস্থিতি আসলে অকার্যকর করে দেয়। এর ফলে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের হস্তক্ষেপ নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ আর কোনো অর্থ বহন করে না। আর সিরিয়ার বর্তমান অস্থিরতা ইসরায়েলের জন্য সুবিধাজনক, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এর ফলে আরব দেশগুলোর এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে পারে।
নেতানিয়াহু ইসরায়েলের এই আগ্রাসনকে সাময়িক নিরাপত্তা পদক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু ইতিহাস বলে অন্য কথা। গোলান মালভূমি সংযুক্তিকরণের বিষয় নিশ্চয়ই কেউ ভুলে যায়নি। ইসরায়েলের যেকোনো স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ যে আসলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ, তা নিয়ে সন্দেহ করার কারণ নেই়। ইসরায়েলের ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর যে দীর্ঘমেয়াদি আকাঙ্ক্ষা, তাঁরা তাদের স্বপ্ন হিসেবে বৃহত্তর ইসরায়েলি ভূখণ্ডের ইঙ্গিত দেয়, তা থেকে তো ধারণা করাই যায় যে ইসরায়েলের সাময়িক অবস্থান আসলে স্থায়ী দখল হয়ে উঠতে পারে।
ইসরায়েলের সিরিয়ায় পদক্ষেপগুলো মূলত তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং আঞ্চলিক অস্থিরতার সুযোগ গ্রহণের ওপর নির্ভরশীল। ডানপন্থী মন্ত্রীরা তাদের আদর্শগত স্বপ্নের জায়গা থেকে বৃহত্তর ভূখণ্ডের দাবি করেন। তবে তা এখনো মূলধারার নীতিতে পরিণত হয়নি। কিন্তু নেতানিয়াহুর সরকার ঐতিহাসিক চুক্তি লঙ্ঘন করে আঞ্চলিক সীমানার পুনর্বিন্যাসের দিকে ইঙ্গিত করছে। পরিস্থিতি অস্থির। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও অভ্যন্তরীণ ইসরায়েলি রাজনীতি এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করবে।
আপনার মতামত জানানঃ