ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন এবং নির্বাচনি মালামাল সংগ্রহের মতো প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো আবারও করতে হবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কে। এসব কার্যক্রম একসঙ্গে পুরোদমে চালালে আগামী ছয় মাসে তা শেষ করা সম্ভব বলে মনে করেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। ওইসব কাজ শেষ করার পর নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করতে পারবে নতুন নির্বাচন কমিশন। সাধারণত তফশিল ঘোষণার ৪৫-৬০ দিনের মধ্যে ভোটগ্রহণ হয়। সেক্ষেত্রে সরকার চাইলে আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব।
তবে প্রস্তুতিমূলক কাজের সব কিছুই নির্ভর করছে অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো ও নিয়োগ পেতে যাওয়া নতুন নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপর। কারণ সংবিধান এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে দুটি কমিশন কাজ করছে। ওই কমিশন দুটি যেসব সংস্কার প্রস্তাব দেবে, সেগুলো বাস্তবায়নের সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজের সরসারি সম্পর্ক রয়েছে। সংবিধান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ও বিধিমালায় সংশোধনী আনা হলে সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে গেলে এই সময়সীমার হেরফের হবে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংস্কার ও নির্বাচন কমিশনের কাজ যদি একই সঙ্গে চলে তাহলে প্রস্তুতি নিতে খুব বেশি সময় লাগবে না। তিনি বলেন, আমরা নির্ধারিত সময় ডিসেম্বরে সুপারিশ করার আশা করছি। একটি নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে আয়োজন করা যায়, সেখানে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকবে সেই লক্ষ্যে আইনি সংস্কারের সুপারিশ সরকারের কাছে করব। সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
আরও জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি হতে যাচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে এটিকে নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরুর কথা বলা হচ্ছে। এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘আগামী ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে সে জন্য তিনি যেকোনো পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দেবেন।’ যদিও বিএনপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়ে আসছে। সরকার এখনো রোডম্যাপ ঘোষণা করেনি। বিষয়টি নিয়ে সরকারের ওপর চাপও তৈরি করছে ওই দলগুলো। সাধারণত রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু হয়।
তবে বর্তমানে নির্বাচন কমিশন না থাকায় প্রস্তুতিমূলক কোনো কাজই হচ্ছে না। নির্বাচন সংক্রান্ত সব ধরনের কাজের সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার একমাত্র কমিশনের।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব শফিউল আজিম বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠন হওয়ার পর তারা যেভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেবেন, সেইভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার সামর্থ্য ও দক্ষতা ইসি সচিবালয়ের রয়েছে। তবে প্রস্তুতি নিতে কতদিন বা মাস লাগবে তা সুনির্দিষ্ট করা কঠিন। কারণ বিভিন্ন আইনে সংশ্লিষ্ট কাজের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া আছে। সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত ওই আইন আমাদের অনুসরণ করতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে ইসি কর্মকর্তাদের। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একপক্ষীয় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় গত ৭ জানুয়ারি। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ওই নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করে তৎকালীন কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। ওই নির্বাচন আয়োজনে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই এখনো স্বপদে বহাল রয়েছেন। ফলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া তাদের জন্য কঠিন কোনো বিষয় না। ওই কর্মকর্তারা বলেন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটের মাত্র চার মাসের মধ্যে ওই বছরেরই ১২ জুন আরেকটি সংসদ নির্বাচন করারও উদাহরণ রয়েছে ইসির।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ওইদিনই ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা। পরের দিন ৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর গঠিত হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ অবসানের ৯০ দিনের মধ্যে ভোট করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যা আগামী ৫ নভেম্বর শেষ হচ্ছে। সরকার সংবিধান স্থগিত না করলেও নির্ধারিত সময়ে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না তা স্পষ্ট।
এক মাসেই কমিশন গঠন সম্ভব
সরকারের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নভেম্বরের মধ্যেই নতুন কমিশন গঠন করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য তড়িঘড়ি করে বিদ্যমান আইনেই সার্চ কমিটি গঠনের কথা মঙ্গলবার জানান আইন উপদেষ্টা ড. অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। যদিও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন একটি খসড়া আইন তৈরি করেছে বলে সংস্কার কমিশনের একাধিক সদস্য যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন। তারা জানিয়েছেন, সরকারের তরফ থেকে আইনের খসড়া চাওয়া হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, সার্চ কমিটি গঠন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যেই মতভেদ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উপদেষ্টা বলেন, আওয়ামী লীগ তড়িঘড়ি করে ওই আইন পাশ করার সময়ে বিভিন্ন মহল সমালোচনা করেছিল। এখন ওই আইনে কমিশন গঠন হলে সমালোচনা কি বন্ধ হবে?
সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আইন অনুযায়ী, প্রজ্ঞাপন জারির ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিটি পদের বিপরীতে দুজনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব করবে সার্চ কমিটি। ওই তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি সিইসি ও কমিশনার নিয়োগ দেবেন। নতুন কমিশন গঠন, শপথ ও দায়িত্ব নিতে এক মাসের কম সময় লাগার কথা।
ভোটার তালিকা ও অন্যান্য প্রস্তুতি
ইসি সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী আগামী ২ জানুয়ারি হালনাগাদ খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। ওই তালিকার ওপর দাবি-আপত্তি ও তা নিষ্পত্তি করার জন্য সময় দেওয়া হবে। এরপর ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। ওই ভোটার তালিকা দিয়েই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা সম্ভব। তারা জানান, গত এক মাসে সব জেলা-উপজেলা কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনলাইনে বৈঠক করেছেন ইসি সচিবালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। ওইসব বৈঠকে ভোটার তালিকায় অসঙ্গতি থাকলে তা দূর করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। যদিও আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল মঙ্গলবার তার বক্তব্যে ভোটার তালিকার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশে ১৩ কোটির বেশি ভোটার রয়েছে।
জানা গেছে, নতুন কমিশন গঠনের পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে ভোটার তালিকা হালনাগাদের প্রস্তাব দেবে ইসি সচিবালয়। সর্বশেষ ২০২২ সালে এ প্রক্রিয়ায় তথ্য সংগ্রহ করে ইসি। সংশ্লিষ্টরা জানান, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে শুধু ভোটার হওয়ার যোগ্যদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়, তাহলে সময় লাগবে ৪-৫ মাস। আর যদি আগের মতো ১৬ বছর বয়সিদেরও তথ্য সংগ্রহ করা হয়, তাহলে সময় লাগবে ৮-৯ মাস। এভাবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে নির্বাচন করতে হলে ভোটার তালিকা আইন-২০০৯ এ সশোধনী আনতে হবে। কারণ বিদ্যমান আইনে প্রতি বছর ২ জানুয়ারি থেকে ২ মার্চের মধ্যে ভোটার তালিকা চূড়ান্তের বিধান রয়েছে।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের রোডম্যাপে ছয় মাসে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের ঘোষণা দিয়েছিল। মূল কাজ ৫ মাসেই শেষ হয়। যেহেতু সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত আইন সংস্কারের কাজ আইন সংস্কার কমিশন করছে, তাই সেখানে হাত দিতে হবে না নতুন কমিশনের। খসড়া তালিকা প্রকাশ, ওই তালিকার ওপর দাবি বা আপত্তি গ্রহণ এবং নিষ্পত্তিতে আগের মতো ৪-৫ মাসে সম্ভব।
জানা গেছে, নির্বাচনি মালামাল ক্রয়, নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন, ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা তৈরি, পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধন কার্যক্রমগুলো একই সঙ্গে নেওয়া হলেও ৩-৫ মাস সময়ের প্রয়োজন হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন দিতেই ৪-৫ মাস সময়ের প্রয়োজন হয়। সময়ের বিভাজন বলতে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন দলের আবেদন জমা দিতে এক মাসের সময় দেওয়া হয়। জমা হওয়া আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়। প্রয়োজনীয় দলিলাদির ঘাটতি থাকলে তা পূরণে আবেদনকারী দলগুলোকে আরও ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়। প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকে যাওয়া দলগুলোর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অফিস ও কমিটি খতিয়ে দেখতেও এক মাসের বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। মাঠ পর্যায় থেকে আসা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে নতুন দল নিবন্ধন দিতে অন্তত ৪-৫ মাস সময়ের প্রয়োজন হয়।
নির্বাচনি মালামাল সংগ্রহ করতেও কমপক্ষে ৩-৫ সময়ের প্রয়োজন হয়। উন্মুক্ত ক্রয় পদ্ধতিতে মালামাল কিনতে ক্রয় সংক্রান্ত আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় দিয়ে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। ঠিকাদার নির্ধারণের পর মালামাল সরবরাহ করতেও সময় দিতে হয়। নির্বাচন কর্মকর্তারা জানান, অনেক ক্ষেত্রে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি হয়। তখন তা নিষ্পত্তি করতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট হয়।
আপনার মতামত জানানঃ