উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেই দেশজুড়ে চলছে শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন বাড়ার প্রেক্ষাপটে বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় উৎসব নির্বিঘ্নে উদযাপন নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। এরই মধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা আরও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে উৎসবমুখর পূজার আয়োজনে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস মিলেছে।
তবে সবকিছুকে দূরে ঠেলে দুর্গাপূজার প্রস্তুতিপর্বে বেশ আনন্দময় পরিবেশের দেখাও মিলেছে। মন্দির-মণ্ডপগুলোতে প্রতিমা নির্মাণ, প্যান্ডেল-মঞ্চ স্থাপন, সাজসজ্জাসহ সেই প্রস্তুতি অনেকটা এগিয়েও গেছে। সবখানেই যেন সাজসাজ রব।
বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় উৎসবের সূচনা হবে আগামী ৯ অক্টোবর, চলবে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত। ২ অক্টোবর দুর্গাদেবীর আবাহন তথা মহালয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে দেবীর আরাধনা। এর এক সপ্তাহ পর ৯ অক্টোবর মহাষষ্ঠীতে দশভুজা দেবী দুর্গার আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হবে পূজার আনুষ্ঠানিকতা। তার আগের দিন আগামী মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে দেবীর আগমনধ্বনি অনুরণিত হবে। আর ১০ অক্টোবর মহাসপ্তমী, ১১ অক্টোবর মহাষ্টমী এবং ১২ অক্টোবর মহানবমী শেষে ১৩ অক্টোবর বিজয়া দশমী ও প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পাঁচ
দিনের দুর্গোৎসব।
সনাতন বিশ্বাস ও পঞ্জিকামতে, জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এবার দোলায় (পালকি) চড়ে স্বর্গালোক থেকে মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) আসবেন; যার ফল হচ্ছে মড়ক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ ও মহামারির প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে। দেবী স্বর্গলোকে বিদায় (গমন) নেবেন গজে (হাতি) চড়ে; যার ফল হিসেবে বসুন্ধরা শস্যপূর্ণা হয়ে উঠবে।
এবার সারাদেশে পূজামণ্ডপের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ সূত্র বলছে, ৫ আগস্টের পর উদ্ভূত পরিস্থিতির পাশাপাশি ফেনী, নোয়াখালীসহ কয়েকটি জেলায় আকস্মিক বন্যার কারণে ওই অঞ্চলের বেশ কিছু মন্দির-মণ্ডপসহ দেশের অনেক মণ্ডপে এবার পূজা হচ্ছে না। চূড়ান্তভাবে পূজামণ্ডপের সংখ্যা এখনও হিসাব করা না গেলেও এবার ৩২ হাজারের কিছু বেশি দাঁড়াবে। গত বছর পূজা হয়েছিল ৩২ হাজার ৪০৮টি মণ্ডপে। তবে ঢাকা মহানগরীতে পূজামণ্ডপের সংখ্যা বেড়েছে। মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির হিসাবে এবার ঢাকা মহানগরীর পূজামণ্ডপের সংখ্যা ২৫৩টি, যা গতবারের তুলনায় সাতটি বেশি।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি পূজামণ্ডপ ঘুরে দুর্গোৎসবের শেষ পর্যায়ের প্রস্তুতি চোখে পড়েছে। কেন্দ্রীয় পূজা উৎসব হিসেবে পরিচিত ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনের দুর্গোৎসবকে ঘিরে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। এই মণ্ডপের প্রতিমা নির্মাণের দায়িত্ব যথারীতি রাষ্ট্রপতি পদকপ্রাপ্ত প্রতিমাশিল্পী সুকুমার পালের ওপরই বর্তেছে। তিনি জানিয়েছেন, প্রতিমা নির্মাণকাজ অনেকটাই এগিয়েছে। মাটির কাঠামোর কাজ শেষ হওয়ার পর রঙের প্রলেপ ও অন্য সাজসজ্জার কাজ শুরুর প্রস্তুতিও চলছে।
দুর্গাপূজার প্রস্তুতি দেখা গেল রাজধানীর গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের পূজামণ্ডপকে ঘিরেও। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতি ও নিরাপত্তাজনিত কারণে এবার সেখানে বরাবরের মতো মিশন মাঠে পূজার আয়োজন করা হচ্ছে না। থাকছে না দুর্গাপূজার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ কুমারী পূজার আয়োজনও।
রমনা কালীমন্দির ও শ্রীমা আনন্দময়ী আশ্রমের পূজামণ্ডপেও দুর্গাপূজার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ততা চোখে পড়েছে। পুরান ঢাকার মন্দির-মণ্ডপেও উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত এই এলাকায় উৎসাহ-উদ্দীপনায় চলছে পূজার প্রস্তুতি।
এদিকে বাঙালির শারদীয় উৎসবের নির্বিঘ্ন আয়োজন সারতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা ও গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে বৈঠক করে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পূজাকে ঘিরে সব রকমের নাশকতা ঠেকাতে মণ্ডপগুলোতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার, র্যাব, বিজিবি, গোয়েন্দা সংস্থা ও উপকূলীয় এলাকায় কোস্টগার্ড মোতায়েন এবং প্রতিটি মণ্ডপে নিজস্ব উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হবে।
মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব সমকালকে বলেন, এবার দুর্গাপূজা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি– সরকার, প্রশাসন এবং দেশবাসীর সহযোগিতায় একটি শান্তিপূর্ণ, সুন্দর ও আনন্দমুখর পরিবেশে পূজা শেষ করতে পারব। এবার মা দুর্গার আগমনের মধ্য দিয়ে সব ধরনের অপশক্তি দূরীভূত হয়ে জগৎজুড়ে শান্তির বারতা ছড়িয়ে পড়বে– এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আপনার মতামত জানানঃ