টানা ভারি বর্ষণ এবং ভারত থেকে ধেয়ে আসা আকস্মিক বন্যায় ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের ১২টি জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ায় এসব এলাকায় বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এসব এলাকার বাড়িঘর, রাস্তা-ঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব কিছু বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অর্ধকোটি মানুষ।
মাছের ঘের, জমির ফসল, তরিতরকারি, ফলের বাগান পানিতে তলিয়ে গেছে। অসংখ্য গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি বানের পানিতে ভেসে গেছে। গৃহপালিত পশুপাখি রাখার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু কিছু এলাকায় মানুষের ঘরের ছাদ ও টিনের চাল ছুঁয়েছে বন্যার পানি।
আমরা শুনে আসছি, প্রতিবেশী দেশ ভারত আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। কথিত বন্ধু ভারত ফারাক্কাসহ অভিন্ন ৫৪টি নদীতে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের বিশাল এলাকা মরুভূমিতে পরিণত করেছে।
আন্তর্জাতিক নিয়ম নীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক নদীতে তিন হাজার ৬০০টি বাঁধ তৈরি করেছে। হিমালয়ের ভাটিতে বাংলাদেশের উজানে এসব বাঁধ ছাড়াও আরো এক হাজার বাঁধের নির্মাণকাজ চলছে পুরোদমে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলো আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে চিহ্নিত। এসব নদীর উজানে কিছু করতে হলে আন্তর্জাতিক আইন মেনেই করতে হবে।
কিন্তু ভারত এ আইনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না। এটা তাদের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। ভারত গঙ্গায় বহু বাঁধ নির্মাণ করে উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সেচপ্রকল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে পদ্মা ও তার অনেক শাখা নদীই শুকিয়ে গেছে। সেচ সঙ্কটসহ নৌপরিবহন ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদীর সংখ্যা ৫৮টি। এর মধ্যে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশকারী ৫৫টি নদী হচ্ছে : গঙ্গা, ইছামতি-কালিন্দী, রায়মঙ্গল, বেতনা-কোদালিয়া, ভৈরব-কপোতাক্ষ, মাথাভাঙ্গা, পাগলা, আত্রাই, পুনর্ভবা, তেঁতুলিয়া, টাঙন, কুলিক বা কোকিলা, নাগর, মহানন্দা, ডাহুক, করতোয়া, তালমা, ঘোড়ামারা, দেওনাই-যমুনেশ্বরী, বুড়ি তিস্তা, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, জিঞ্জিরাম, চিল্লাখালী, ভোগাই, নিতাই, সোমেশ্বরী, জাদুকাটা, ধামারিয়া-জাদুখালী, নওয়াগাং, উমিয়াম, ধলা, পিয়াইন, সারি-গোয়াইন, সুরমা, কুশিয়ারা, সোনাই-বরদল, জুরি, মনু, ধলাই, লংলা, খোয়াই, সুতাং, সোনাই, হওড়া, বিজনী, সালদা, গোমতি, কাকরাই-ডাকাতিয়া, সিলোনিয়া, মুহরী, ফেনী ও কর্ণফুলী।
ভারত শুধু ফারাক্কা নয়, গঙ্গা-পদ্মাকেন্দ্রিক বাঁধ, জলাধার, ক্রসড্যাম, রেগুলেটরসহ অন্তত ৩৩টি মূল অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। এর সাথে রয়েছে আনুষঙ্গিক আরো বহু ছোট-বড় কাঠামো। নতুন করে উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সরকার ৫৩টি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রকৃতিগত দিক দিয়ে নদী বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বুনিয়াদ। পেশাগত দিক থেকে জীবন-জীবিকার একটি অংশ নির্ভরশীল এ দেশের নদ-নদীর ওপর। এ দেশের কৃষি সম্পদ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, পরিবেশ- এর সবই নদীনির্ভর। অর্থাৎ নদীকে বাদ দিয়ে এ দেশের উন্নয়ন তথা মানুষের জীবন কল্পনাই করা যায় না। সংখ্যার দিক থেকে মতপার্থক্য থাকলেও কমপক্ষে চার শতাধিক নদ-নদী জালের মতো বিস্তার করে আছে পুরো দেশে।
বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে, কখনো যদি ৮ রিখটার স্কেলে কোনো ভূমিকম্প বাংলাদেশে হয় তাহলে প্রধান প্রধান নদীগুলোর প্রবাহপথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র এ চারটি নদীর ওপর আঘাত এলেই এর অন্তর্গত শাখা ও উপনদীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং শুকিয়ে যাবে।
মূল নদী ও উপনদীতে বাঁধ দেয়ার ফলে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়ায় ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের বহু পানির উৎস চিরতরে হারিয়ে যাবে।
আপনার মতামত জানানঃ