দেশে ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স এসেছে জুলাইয়ে। জুনের তুলনায় গত মাসে ৬৩ কোটি ডলার বা প্রায় ২৫ শতাংশ কম রেমিট্যান্স এসেছে। প্রবাসী আয়ে বড় পতনের এ ধাক্কা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর পড়েছে। জুলাইয়ে রিজার্ভ কমেছে প্রায় ১৩০ কোটি বা ১ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গতকাল রিজার্ভ ও রেমিট্যান্সের এ তথ্য জানানো হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ৩০ জুন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড (বিপিএম৬) অনুসারে দেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। ৩১ জুলাই তা ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। তবে ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ এখন ১৫ বিলিয়ন ডলারের কম বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ ছিল ২০২১ সালের আগস্টে। ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন পদ্ধতি অনুসারে গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এর পর থেকেই ধারাবাহিক ক্ষয় চলছে। টানা পতনের পর জুনে এসে রিজার্ভের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছিল। এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল রেমিট্যান্সের বড় প্রবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে পাওয়া ঋণ। গত ২৯ মে বিপিএম৬ অনুসারে দেশের রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। ৩০ জুন তা বেড়ে ২১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তখন জানানো হয়, জুনে আইএমএফ থেকে প্রতিশ্রুত ঋণের তৃতীয় কিস্তি বাবদ ১১৫ কোটি ডলার ছাড় হয়। পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়া, আইবিআরডি, আইডিবিসহ বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা থেকে ৯০ কোটি ডলার ঋণ পায় বাংলাদেশ। ঋণের এ অর্থ যুক্ত হওয়ায় জুনে রিজার্ভের পরিমাণ কিছুটা বাড়ে। কিন্তু এক মাস না যেতেই আবারো আগের চেহারায় ফিরেছে রিজার্ভ।
তবে রিজার্ভ কী কারণে এতটা কমেছে সেটি গণমাধ্যমে বলা যাবে না বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘এখন থেকে মাসে একবার রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করা হবে। তবে রিজার্ভ কী কারণে কমেছে সেটি বলা হবে না।’
আধুনিক অর্থনীতি ও প্রযুক্তির এ যুগে এসে বাংলাদেশ ব্যাংক পুরোপুরি উল্টো দিকে হাঁটছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ, ডলারের বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতির মতো অর্থনীতির মৌলিক সূচকগুলোর প্রকৃত তথ্যের পাশাপাশি ভবিষ্যতে কী হবে, সেটিও বলে দেয়। কিন্তু আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন তথ্য গোপন রাখার চেষ্টায় আছে। আইএমএফে চাকরি করার সময় আমি পাকিস্তানে ছিলাম। তখন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিনে দুবার রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করত। আমরা দেখছি, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন মাসে একবার রিজার্ভের তথ্য জানাচ্ছে। অন্যান্য তথ্যও তারা গোপন রাখছে। গোপনীয়তা কখনই দেশ কিংবা সরকারের জন্য ভালো নয়। কোনো তথ্য গোপন রাখা আত্মঘাতী কাজ।’
দেশের রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। গত অক্টোবর থেকে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রবৃদ্ধির ধারায় ছিল। এর মধ্যে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে প্রতি মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। কিন্তু জুলাইয়ে এসে সে প্রবাহে লেগেছে বড় ধরনের ধাক্কা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গতকাল জানানো হয়, জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯০ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এর আগে জুনে ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার এসেছিল। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে দেশে প্রবাসীদের আয় ৬৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার কম এসেছে। এক্ষেত্রে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে প্রবাসীরা ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। এ হিসাবেও গত মাসে রেমিট্যান্স ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ কমেছে।
প্রতি মাসের ১ তারিখে আগের মাসের রেমিট্যান্সের বিস্তারিত তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়। কিন্তু গতকাল তা প্রকাশ করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তার মাধ্যমে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে রেমিট্যান্সের তথ্য পাঠান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ের প্রথম ১৩ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৯৭ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। ১৪ থেকে ২০ জুলাই ৪৫ কোটি ৭ লাখ ডলার আসে। এর পর ২১ থেকে ২৭ জুলাই প্রবাসী আয় আসে মাত্র ১৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার। মাসের শেষ চারদিনে ৩৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার এসেছে বলে মেজবাউল হক জানিয়েছেন। তিনি জানান, কেবল ৩১ জুলাই ১২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ১৬ জুলাই দেশব্যাপী সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২১২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। যদিও সরকারের হিসাবে নিহতের সংখ্যা ১৫০। তাছাড়া আন্দোলনকে ঘিরে ১৮ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ ছিল। একই সময় বন্ধ ছিল ব্যাংকসহ অর্থ লেনদেনের আনুষ্ঠানিক প্রায় সব মাধ্যম। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কারফিউ জারির পাশাপাশি দেশব্যাপী সেনাবাহিনী মোতায়েন করে সরকার। দেশে সংঘটিত সহিংসতা ও মৃত্যুর ঘটনায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যেও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ, আমেরিকার কয়েক দেশে প্রবাসীরা সমাবেশ ও বিক্ষোভ করেন। এর মধ্যে কোনো কোনো সমাবেশ থেকে রেমিট্যান্স ‘শাটডাউনের’ ঘোষণাও আসে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ‘শাটডাউনের’ ঘোষণার পর দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে গিয়েছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় ১২ ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীকে ডেকে রেমিট্যান্স বাড়ানোর তাগিদ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স সংগ্রহের ক্ষেত্রে এতদিন ডলারপ্রতি ১১৭-১১৮ টাকা পরিশোধ করছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পেয়ে ১২০ টাকা দরেও ডলার কিনে নেয়। এ কারণে মাসের শেষ তিনদিনে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে।
এদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার প্রভাবে দেশের খুচরা বাজারে (কার্ব মার্কেট) ডলারের দর ৫-৬ টাকা বেড়ে গেছে। গত ১৭ জুলাই কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের দর ছিল ১১৯-১২০ টাকা। গতকাল প্রতি ডলার লেনদেন হয়েছে ১২৫ টাকা পর্যন্ত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবাসীরা ২ হাজার ৩৯১ কোটি বা ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠান। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছিলেন তারা।
আপনার মতামত জানানঃ