একসময় ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে সর্বত্র দেখা মিলত এমন পাখি ছিল শকুন। সে সময় গবাদি পশুপাখির মৃতদেহের খোঁজে বিস্তীর্ণ ভাগাড়ের ওপর ঘুরে বেড়াত এইসব ময়লা-সাফ-করা পাখি। তবে দুই দশকেরও বেশি সময় আগে অসুস্থ গরুর চিকিৎসায় ব্যবহৃত এক ওষুধের কারণে মরে যেতে শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতির ভারতীয় শকুন।
১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে পাঁচ কোটি শকুনের সংখ্যা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নেমে আসে কেবল ডাইক্লোফেনাক ওষুধের কারণে। গবাদি পশুদের জন্য সাশ্রয়ী ব্যথানাশক ওষুধ ডাইক্লোফেনাক, যা শকুনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। যেসব শকুন এই ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা গবাদি পশুর মৃতদেহ খেয়েছিল সেসব শকুন কিডনি বিকল হয়ে মারা গেছে।
২০০৬ সালে পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে কিছু কিছু জায়গায় শকুন কমে যাওয়ার গতি কমলেও অন্তত তিনটি প্রজাতির শকুন দীর্ঘমেয়াদে ৯১-৯৮ শতাংশ ক্ষতির মুখে পড়েছে।
তবে বিষয়টি এখানেই শেষ হয়নি। ‘আমেরিকান ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশন’ জার্নালে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক এ গবেষণায় উঠে এসেছে, অনিচ্ছাকৃতভাবে শকুন ধ্বংস হওয়ার ফলে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লাখ লোক মারা গেছেন।
“শকুনকে প্রকৃতির স্যানিটেশন বা জঞ্জাল সাফাই হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কারণ আমাদের পরিবেশ থেকে ব্যাকটেরিয়া ও রোগজীবাণু রয়েছে এমন মৃত প্রাণীদের দেহ সরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে শকুন। এরা না থাকলে পরিবেশে বিভিন্ন রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে,” বলেছেন এ গবেষণার সহ-লেখক ও ‘ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো হ্যারিস স্কুল অফ পাবলিক পলিসি’র সহকারী অধ্যাপক আইয়াল ফ্রাঙ্ক।
“মানব স্বাস্থ্যে শকুনের এমন ভূমিকা, বন্যপ্রাণী রক্ষার গুরুত্বকে তুলে ধরে। আর এ বিষয়টি কেবল সুন্দরই নয়। বরং বাস্তুতন্ত্রে সকল প্রাণীর একটি ভূমিকা রয়েছে যা আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে।”
শকুন কমে যাওয়ার আগে ও পরে ঐতিহাসিকভাবে কম শকুনের সংখ্যার সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন জেলাতে মানুষের মৃত্যুর হারের তুলনা করেছেন ফ্রাঙ্ক ও তার সহ-লেখক অনন্ত সুদর্শন। এজন্য তারা জলাতঙ্কের টিকা বিক্রি, বন্য কুকুরের সংখ্যা ও পানি সরবরাহে রোগজীবাণুর মাত্রাও পরীক্ষা করেছেন।
গবেষকরা দেখেছেন, ব্যথানাশক ওষুধের বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় শকুনের সংখ্যা কমে গেছে এবং যেসব জেলায় শকুন একসময় অনেক বেশি সংখ্যায় ছিল সেখানে মানুষের মৃত্যুর হার ৪ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।
গবেষকরা আরও দেখেছেন, এ প্রভাবটি সবচেয়ে বেশি ছিল শহুরে অঞ্চলে। যেখানে বড় পরিসরে গবাদি প্রাণীর অবস্থান ও মৃতদেহের ভাগারও ছিল সাধারণ বিষয়।
লেখকরা অনুমান করেছেন, ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে শকুন ব্যাপক হারে কমে যাওয়ার ফলে সে সময় প্রতি বছর অতিরিক্ত প্রায় এক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর এই অকাল মৃত্যুর জন্য প্রতি বছর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৬৯ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
এমনটা হয়েছিল মরণব্যাধি রোগ ও ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণে, যা শকুন পরিবেশ থেকে সরিয়ে ফেলত। কিন্তু ব্যাপক হারে শকুন কমে যাওয়ার কারণে পরিবেশ থেকে এসব সরানো সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
যেমন– সেই সময় শকুন না থাকায় খ্যাপাটে কুকুরের সংখ্যা অনেক বেশি বেড়ে যায়। যা মানুষের মধ্যে জলাতঙ্ক ছড়ায়। সে সময় জলাতঙ্কের টিকার বিক্রি বাড়লেও তা অপর্যাপ্ত ছিল। শকুনের বিপরীতে বিভিন্ন কুকুর সেই সময় পরিবেশের এইসব পচা দেহাবশেষ পরিষ্কার করতে পারেনি। যার ফলে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও রোগজীবাণু পানিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং পানিতে জীবাণুর পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যায়।
ভারতে শকুন প্রজাতির মধ্যে সাদা রাম্পড শকুন, ভারতীয় শকুন ও লাল মাথাওয়ালা শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়ার হার ২০০০ এর দশকের গোড়ার দিকে সবচেয়ে বেশি ছিল। এসব প্রজাতির শকুনের সংখ্যা ৯৮ শতাংশ, ৯৫ শতাংশ ও ৯১ শতাংশ কমেছে। মিশরীয় শকুন ও পরিযায়ী গ্রিফন শকুনও কমে যায়। তবে অন্যান্য শকুন প্রজাতির তুলনায় তা কম বিপর্যয়কর।
২০১৯ সালের পশু শুমারিতে ভারতে ৫০ কোটিরও বেশি প্রাণী রেকর্ড করা হয়েছে, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। শকুন অত্যন্ত দক্ষ মেথর হওয়ায় কৃষকরা প্রচলিতভাবে গবাদি পশুর মৃতদেহ দ্রুত সরানোয় এদের উপর নির্ভর করত।
গবেষকদের মতে, ভারতে শকুন কমে যাওয়ার বিষয়টি পাখি প্রজাতির মধ্যে রেকর্ড দ্রুততম ছিল। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে যাত্রী কবুতর বিলুপ্ত হওয়ার পর এটিই সবচেয়ে বড় বিলুপ্তির ঘটনা।
শকুন কি আবার ফিরে আসবে? কিছু আশাব্যঞ্জক লক্ষণ থাকলেও এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। সাম্প্রতিক জরিপে দক্ষিণ ভারতে ৩০০-র বেশি শকুন নথিভুক্ত করা হয়েছে। তবে আরও পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
আপনার মতামত জানানঃ