বাংলাদেশের যশোরের অভয়নগর উপজেলায় পুলিশ হেফাজতে এক নারীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। আফরোজা বেগম নামে ওই নারীকে শনিবার রাতে অভিযান চালিয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এ সময় তার কাছে ৩০টি ইয়াবা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ওইদিন গ্রেপ্তারের পর অভয়নগর থানা হাজতে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। রোববার সকালে থানা হাজতে থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়েন আফরোজা বেগম। চিকিৎসার জন্য তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর আবার থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
এরপর আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা তখন উন্নত চিকিৎসার জন্য যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন।
এটি যশোর সদর হাসপাতাল নামে পরিচিত। হাসপাতালে নেয়ার পর রোববার সকাল সাড়ে এগারটার দিকে জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
যশোর সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রোগী অসুস্থ হলে প্রথমে অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে ডাক্তাররা দেখে তার প্রেশার ২২০/১১০। পরে তারা রেফার করলে পুলিশ আমাদের এখানে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসে। এখানে জরুরি বিভাগের ডাক্তাররা জানান সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ার কারণে রোগী মারা গেছেন।”
মৃত আফরোজা বেগমের পরিবারের পক্ষ থেকে এ ঘটনায় আদালতে মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি চলছে বলে জানানো হয়েছে।
ঘটনার আদ্যোপান্ত
অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের আবদুল জলিল মোল্লার স্ত্রী আফরোজা বেগম। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে আফরোজা বেগমের ছোট ছেলে সাব্বির মোল্লা অভিযোগ করেন শনিবার রাতে সাড়ে এগারটার পরে পুলিশ বাড়িতে এসে তল্লাশি চালিয়ে তার মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেয়।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “সাড়ে এগারটার দিকে ভাত খাওয়ার জন্য আম্মু পানি আনতে যাচ্ছিল। ওই সময় আব্বুকে খুঁজতে এক লোক আসে। আম্মু বলে আব্বু ইজি-বাইক স্ট্যান্ডে। পরে আব্বুকে এনে কথা বলার পর আব্বু আবার চলে যায়। সেই লোক আবার আসে। আম্মু পানি আনতে গেছিল। ওখান থেকে আসার পরে ওইসময় পাঁচ ছয়জন পুলিশ ও তাদের সোর্সসহ দশজনের মতো ঘরে ঢুকলো।”
এ সময় উপ-পরিদর্শক সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে সহকারী উপ-পরিদর্শক সিলন আলী, এএসআই শামসুল হক ও নারী কনস্টেবল রাবেয়া খানম অভিযানে তল্লাশি চালান।
মি. মোল্লা বলেন, “আব্বুর পরিচিত যে লোক আসছিল তার পকেট থেকে কী জানি পায়। পরে আম্মুকে সার্চ করে, বাড়িতেও করে। বলে তোমার কাছে কী আছে দাও। যার পকেট থেকে কিছু পায় তাকে ছেড়ে দেয়। পরে আম্মুকে বলে কিছু পাইলেও আজকে মামলা দিবো, না পেলেও মামলা দিবো। পাঁচজন পুলিশ ছিল তারা। তাকে খালি চড় থাপ্পড় মারছিল। আম্মু বারবারই বলছিল আমার কাছে কিছু নাই।”
এক পর্যায়ে আফরোজা বেগমকে ফ্যানের সাথে বেঁধে নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ করেন মি. মোল্লা। একইসাথে মাকে চড়-থাপ্পড় মারার সময় ঠেকাতে গেলে তাকেও মারধর করা হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।
“আমাকে ঘর থেকে বের করে দেয়। সিলন দারোগা আম্মুর কাছে কিছু না পাওয়ার পরও তাকে মাথায়, মুখে চড় মারে। পরে কিছু না পেয়ে মহিলা পুলিশ আসার পর তাকে ঘরের ভেতরেই ফ্যানের সাথে চুল বেঁধে ফ্যান চালু করে দেয় সিলন দারোগা,” বলেন মি. মোল্লা।
অজ্ঞান অবস্থায় রাত আনুমানিক দুইটায় তাকে পুলিশ গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ করা হয় পরিবারের পক্ষ থেকে।
আফরোজা বেগমের স্বামী আবদুল জলিল মোল্লা পুলিশের বিরুদ্ধে বাড়ি থেকে টাকা লুট করে নেয়ার অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, “আমার ঘর লুট হয়ে গেল, পুলিশ আমার গাড়ি বেচার টাকা সব নিয়ে গেল, বউয়ের সোনাদানা নিয়ে গেল। এক সপ্তাহ আগে গাড়ি বিক্রি করে এক লাখ ৮৮ হাজার টাকা বাসায় ছিল।”
“আমার বাচ্চারা এখন মানুষ হবে কীভাবে? আমাকে নিয়ে যেত আমার আফসোস ছিল না,” বলেন মি. মোল্লা।
প্রতিবেশীরা জানান, ঘটনার দিন শনিবার রাতে কয়েকজন পুলিশ আফরোজা বেগমের ঘরে তল্লাশি চালায়। দুই রুমে তল্লাশি চালিয়ে কিছু পায়নি তারা। পরের দিন সকাল সাড়ে এগারটায় আফরোজা বেগমের মারা যাওয়ার খবর শোনেন প্রতিবেশীরা।
বড় ছেলে মুন্না মোল্লা জানান, “রোববার সকালে মায়ের জন্য থানায় নাশতা দিতে গিয়ে শুনি তার শরীর খারাপ। প্রথমে তাকে অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক ওষুধ লিখে দেন এবং কিছু পরীক্ষা করতে দেন। কিন্তু তা করতে দেয়া হয়নি। পরে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। গাড়িতে আমিও ছিলাম। পথে মায়ের শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। হাসপাতালে আনার পর জানতে পারি মা মারা গেছে।”
আফরোজা বেগমের ভাই নুর ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এ ঘটনায় আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।”
যশোর সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ওনার পোস্টমর্টেম হয়েছে। পরে ডাক্তারের সাথে কথা বলে জেনেছি কোনো নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। রিপোর্ট প্রসেসিং হচ্ছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেতে একটু সময় লাগবে। হয়তো দুই – একদিনের মধ্যে রিপোর্ট পুলিশের হাতে সিভিল সার্জনের মাধ্যমে হস্তান্তর করবো।”
একইসাথে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে আফরোজা বেগমের মৃত্যু হয়েছে বলে ডেথ সার্টিফিকেটও দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে বলে জানান তিনি।
আপনার মতামত জানানঃ