গাজা উপত্যকার আল-মাওয়াসি শরণার্থীশিবির। শিবিরের অস্থায়ী তাঁবুতে সন্তানদের যত্নআত্তি করার ফাঁকে যখনই সময় পান সাগরতীরে যান ফিলিস্তিনি বিধবা জোহরা (২৬)। বসে ভূমধ্যসাগরের রূপ বদলানো দেখেন। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে সাগরের পানি নীল বর্ণ ধারণ করে। আবার সূর্য ডোবার সময় পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে সোনালি আর লাল রং মেশানো আভা। উত্তরে এ সাগরের ঢেউয়ে ভেজে ইসরায়েলের তেল আবিবের সমুদ্রসৈকত।
এ সাগরেরই বুক থেকে ছুটে আসা একটি গুলি জোহরার স্বামী মাহমুদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। সেই ঘটনার বর্ণনা করে জোহরা বলছিলেন, ‘ও (জোহরার স্বামী) সাগরতীরের দিকে যাচ্ছিল। সেখানে গাড়ি ও ত্রাণবহর ছিল। মানুষের ভিড় জমেছিল সেখানে। সামরিক নৌযান থেকে ভিড় লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হলে ওর মাথায় গুলি লাগে।’
ঘটনাটি গত ৯ ফেব্রুয়ারির। সদ্য চতুর্থ সন্তানের মা হওয়া জোহরা খবরটি পেয়েছিলেন একটু দেরিতে। ঘটনাস্থলে ছিলেন ও পুরো ঘটনা জানতেন এমন কয়েকজন তরুণের কাছে মাহমুদের খোঁজ জানতে চেয়েছিলেন জোহরা। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁরা তাঁকে কিছু জানাননি। শুধু বলেছিলেন, মাহমুদের ফিরতে এমনিতেই দেরি হচ্ছে। তবে জোহরার মনে হচ্ছিল, খারাপ কিছু একটা হয়েছে।
পরে মাহমুদের ভাই আর্তনাদ করতে করতে জোহরার কাছে এসে বলেন মাহমুদ আর নেই। শুনেই জোহরা হাসপাতালে ছোটেন। সেখানে গিয়ে নিশ্চিত হন মাহমুদ এমন জায়গায় চলে গেছেন, যেখান থেকে তাঁর ফিরে আসার সুযোগ নেই।
বিবিসির প্রতিনিধিকে কথাগুলো বলতে গিয়ে একপর্যায়ে থেমে যান জোহরা। মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। মাকে এভাবে দেখে তিন বছরের সন্তান লানা এসে তাঁর হাত ধরে। মায়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকা ছোট ভাইয়ের গায়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল সে।
এরপর জোহরা আবার কথা বলতে শুরু করেন। বলেন, ‘মাহমুদের পুরো শরীর যন্ত্রের সঙ্গে লাগানো ছিল। ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল শরীর। আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে পারলাম না। চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু জবাব দিচ্ছিল না। ও ঘুমাচ্ছিল…। সন্তানদের জন্য খাবার আনতে গিয়েছিল ও। আর ফিরে এল কফিনে করে।’
যুদ্ধ জোহরার পরিবারকে তছনছ করে দিয়েছে। এর আগে তাঁরা গাজা সিটিতে থাকতেন। মাহমুদ ‘পাইওনিয়ার ফুড’ নামের একটি কোম্পানিতে কাজ করতেন শ্রমিক হিসেবে। যুদ্ধ শুরুর পর গাজা উপত্যকার কেন্দ্রে আল-নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে পালিয়ে যান তাঁরা। পরে সেখান থেকে তাঁদের উচ্ছেদ করা হয়। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী তাঁদের বলেছিল, দক্ষিণ রাফা নিরাপদ অঞ্চল। এরপর তাঁরা সেখানে চলে যান।
জোহরা এখন গাজার আল-মাওয়াসি শরণার্থীশিবিরের ‘এতিম ও বিধবাদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে’ আরও অনেক বিধবার সঙ্গে থাকছেন। অস্থায়ী শিবিরের স্থানটি সঙ্গীহারা নারী ও শিশুদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
জোহরার আশ্রয়স্থলটি বেশ ছোট পরিসরের। আশপাশে সারাক্ষণ মাছি ভনভন করে।
জোহরা তাঁর মৃত স্বামী মাহমুদের ছবি দেখান। বলেন, ‘মাহমুদ পরিবারের প্রতি অনেক দায়িত্বশীল ছিল। তাকে ছাড়া কীভাবে চলব, আমি জানি না। সে–ই ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি। আমাকে কখনো কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দেয়নি। এখন আমাদের জন্য চিন্তা করার কেউ নেই।’
জোহরা মনে করেন, বিধবা নারীদের জন্য শরণার্থীর এমন জীবন অনেক অসম্মানের। জোহরার কোলে থাকা নবজাতক ও আরেক প্রতিবন্ধী সন্তান মোস্তফার জন্য অনেক ডায়াপার প্রয়োজন। মোস্তফা খুব অস্থির। কিছু দেখলেই সে চায়, নয়তো নিজেই নিজেকে আঘাত করা শুরু করে। মোস্তফা খাবার চায়, ফল চায়, কোমল পানীয় চায়। কিন্তু তার এত চাহিদা মা জোহরার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব হয় না।
কয়েক দিন আগে জোহরাদের প্রতিবেশী এক পরিবার কোনোভাবে একটি মুরগি জোগাড় করেছিল। একটু মাংস খাওয়ার আশায় জোহরার সন্তানরা অনেকক্ষণ তাদের পাশে হাঁ করে বসে ছিল। লানা কিছুক্ষণ পরই খাবারের জন্য কাঁদতে শুরু করে। কিন্তু জোহরার কিছুই করার ছিল না।
জোহরার প্রতিবেশী আমিনাও একজন বিধবা। গাজার খান ইউনিস এলাকার কাছে ইসরায়েলের বিমান হামলায় আমিনা স্বামীসহ তিন সন্তান হারিয়েছেন। এ হামলার পর আমিনা ও তাঁর ৫ বছর বয়সী সন্তান ইব্রাহিমকে ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত টেনে বের করা হয়েছিল। তাঁর সন্তানও চলাফেরা করতে পারে না।
আরেক বিধবা নারী আমানি জাসের আল-খাওয়ার যুদ্ধে তাঁর স্বামী ও সন্তানকে হারিয়েছেন। অক্টোবর মাসে গাজায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় তাঁরা নিহত হন।
আল-মাওয়াসি শিবিরে আশ্রয় নেওয়া বিধবারা একটি নতুন শিবিরের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছেন। সেখানে সঙ্গীহারা নারী ও এতিম শিশুরা পর্যাপ্ত খাবার, ভালো বাসস্থানসহ বিভিন্ন সুবিধা পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এই নারীদের চাওয়া, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হত্যাকাণ্ড যেন বন্ধ হয়। তাঁদের যেন আর কাউকে হারাতে না হয়।
আপনার মতামত জানানঃ