পরিচালনা-ব্যবস্থাপনার ঘাটতি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল নজরদারির মধ্যে ৩৮টি ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি মিলে ১২টি ব্যাংক নাজুক দশায় রয়েছে। এর মধ্যে চরম নাজুক হওয়ায় ৯টি ব্যাংক রেড জোনে রয়েছে। আর তিনটি ব্যাংক আছে রেড জোনের খুব কাছাকাছি, ইয়েলো জোনে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২৩ সালের জুনভিত্তিক ‘ব্যাংক হেলথ ইনডেস্ক (বিএইচআই) অ্যান্ড হিট ম্যাপ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
রেড জোনে থাকা ৯ ব্যাংকের মধ্যে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত। তালিকার শীর্ষে আছে এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। দ্বিতীয় অবস্থানে পদ্মা ব্যাংক। এরপর যথাক্রমে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও এবি ব্যাংকের অবস্থান।
ইয়েলো জোনে থাকা ৩ ব্যাংক হলো- বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল), রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মো. নুরুল আমিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ব্যাংকগুলোর দুর্বল হওয়ার পেছনে পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা, এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল মনিটরিংও দায়ী থাকতে পারে। তবে ‘দুর্বল মানে একেবারে শেষ হয়ে যাওয়া নয়’।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা ৬১। তবে আলোচ্য প্রতিবেদনে ৫৪টি ব্যাংকের তথ্য নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অবস্থার অবনতি হয়ে ৩৮টি ব্যাংক দুর্বল পয়ে পড়েছে। আর ১৬টির অবস্থার উন্নতি হয়েছে।
বাকি সাত ব্যাংকে মধ্যে তিনটির আর্থিক অবস্থা সংকটে রয়েছে বলে প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এই ব্যাংক তিনটির তথ্যে ব্যাপক অসংগতি ও ভিন্নতা পাওয়া গেছে। এজন্য ব্যাংকগুলোর তথ্য আলোচ্য পর্যবেক্ষণেই নেওয়া যায়নি। অপর চারটি ব্যাংকের তথ্যও বিবেচনায় নেওয়া সম্ভব হয়নি। এগুলো হলো বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটিজেনস ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এরকম গ্রেড প্রতিবছর করা হয়। এতে ব্যাংকগুলোর অবস্থান ফুটে ওঠে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুর্বল এবং নাজুক ব্যাংকগুলোর জন্য সুপারিশ বাস্তবায়নে বিশেষ নজর দেয়।
তবে এবার বেশি আলোচনার কারণ হলো সামনে দুর্বল ও সবল ব্যাংক একীভূত করা হবে। এজন্য ব্যাংকগুলোও নিজেরা অবস্থার উন্নতি ঘটাতে চেষ্টা করবে। তার পরও যদি উন্নতি না হয়, তখন একীভূত করা হবে। তবে যদি কোনো ব্যাংকের অবস্থা ভালো হয় সেটি একীভূত হবে না। এমনকি গ্রিন তালিকায় স্থান পেতে পারে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিচারে রেড জোনের ব্যাংকগুলো সবচেয়ে নাজুক (পুওর) এবং ইয়েলো জোনের ব্যাংকগুলো দুর্বল (উইক)। আর গ্রিন জোনের ব্যাংকগুলো ভালো মানের (গুড)। সে হিসাবে দেশে এখন দুর্বল ব্যাংকের সংখ্যাই বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দুর্বল ব্যাংকগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। সম্প্রতি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনুমোদন নিয়ে ওই প্রতিবেদন অফসাইট সুপারভিশন, ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি এবং পরিদর্শন বিভাগগুলোতে পাঠানো হয়েছে।
ব্যাংক একীভূত করার তালিকায় রেড জোনের নাজুক ব্যাংকগুলোর প্রতি বাড়তি নজর রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। আগামী বছরের মার্চ মাস থেকে এসব ব্যাংক একীভূত করার কথা আছে। তবে এর মধ্যে কোনো ব্যাংকের অবস্থার উন্নতি হলে সেটা ভালো হওয়ার নতুন সুযোগ দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ব্যাংকের একটা এক্সিট পলিসি বা একীভূত করার বিধান ভালো। কিছু দুর্বল ব্যাংককে বন্ধ করার জন্য এই মুহূর্তে এক্সিট পলিসি নিতে হবে। দায়ীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্যই এটা করতে হবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্টাবিলিটি বিভাগ ২০১৫ সালের জুন থেকে নিয়মিত ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য সূচক ও হিটম্যাপ প্রতিবেদন তৈরি করে আসছে। এই প্রতিবেদন তৈরিতে ক্যামেলস রেটিং ও ব্যাসেল-৩ আওতায় প্রস্তাবিত লিভারেজ অনুপাত বিবেচনায় নেওয়া হয়। ব্যাংকের সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিমাপের মানদণ্ড হলো ক্যামেলস রেটিং।
আপনার মতামত জানানঃ