স্যার আইজ্যাক নিউটন মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে সূত্রবদ্ধ করেছিলেন তিনশো বছরেরও বেশি সময় আগে। তারপরে বহু পথ হেঁটেছে মানবসভ্যতা। আধুনিক বিশ্বের অনেক আবিষ্কারই দাঁড়িয়ে আছে সেই মৌলিক গবেষণার উপর ভিত্তি করে। নিউটনের সূত্র থাক বা না থাক, জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মাধ্যাকর্ষণ। তাকে অস্বীকার করবে কে? কিন্তু না, সেরকম লোকও আছেন। তাঁর নাম রজার ব্যাবসন (Roger Babson)। যাঁর জীবনের একটা বড়ো সময় কেটেছে মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে ‘লড়াই’ করে।
রজার ব্যাবসনের পরিচয় এক কথায় দেওয়া মুশকিল। তিনি ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, শিল্পপতি, লেখক এবং অন্ত্রপ্রনর। হয়তো বাদ থেকে গেল আরো কিছু পরিচয়। ১৮৭৫ সালে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে জন্ম। এমআইটি-র মতো খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ডিগ্রি পাওয়ার পর শুরু করলেন ব্যবসা। জনসাধারণের পুঁজি বিনিয়োগের তথ্য বিশ্লেষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেতে থাকে তাঁর কোম্পানি।
ক্রমে হাত বাড়ান আরো কিছু ব্যবসায়। দ্রুত কোটিপতি হয়ে গেলেন তিনি। প্রতিষ্ঠা করেন ব্যাবসন কলেজ, যাকে আমেরিকার অন্ত্রপ্রনরের অন্যতম সেরা প্রশিক্ষণকেন্দ্র বলে ধরা যেতে পারে। লিখেছেন চল্লিশটিরও উপরে বই। কিন্তু ব্যাবসনের আসল খ্যাতি এগুলির জন্য নয়। মূলত দুটি বিষয়ের জন্যই আজও চর্চিত তিনি। আর দুটোর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্ব।
১৯২৯ সালে আমেরিকায় নেমে আসে অর্থনৈতিক মহামন্দা। পোশাকি ভাষায় ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’। সারা বিশ্বেই তার মারাত্মক ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে। নিঃস্ব হয়ে যান বহু মানুষ। কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হন বহু ব্যবসায়ী-শিল্পপতি। কিন্তু ব্যাবসনের গায়ে সেভাবে আঁচও ফেলতে পারেনি মহামন্দা। বহু আগেই তিনি টের পেয়েছিল অর্থনৈতিক দুর্যোগের আগমনবার্তা। কীভাবে? মাধ্যাকর্ষণের সাহায্যে। যা উপরে যায়, তা নেমে আসে নিচে।
এটাকেই যদি মাধ্যাকর্ষণের মূল বিষয় বলে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে তার প্রয়োগ দেখা যাবে রোজকার জীবনেও। সেটা মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যগুলির ক্ষেত্রেও সত্যি, আবার অর্থনীতির ক্ষেত্রেও। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার পুঁজি খেটেছিল ইউরোপের যুদ্ধরত দেশগুলির মধ্যে। এক লাফে অনেকটাই উপরে উঠে গেছিল শেয়ার বাজার। ব্যাবসন অঙ্ক কষে দেখেছিলেন, কবে তা নিচে নামতে পারে। আর সেভাবেই তিনি বাঁচিয়েছিলেন কোটি কোটি টাকা।
জীবনের ছোটোখাটো ঘটনাতেও তিনি একসময় খুঁজতেন মাধ্যাকর্ষণের সূত্র। ছোটোবেলায় তাঁর বোনের জলে ডুবে মৃত্যু প্রসঙ্গেও মনে হয়েছিল, মাধ্যাকর্ষণের সঙ্গে ঠিকভাবে লড়তে পারেনি বলেই ঘটেছিল এরকম দুর্ঘটনা। কিন্তু সমস্ত কিছু এলোমেলো হয়ে গেল ১৯৪৭ সালে। একইভাবে জলে ডুবে মারা গেল তাঁর নাতি। তখন থেকে মাধ্যাকর্ষণ হয়ে গেল তাঁর ‘শত্রু’। প্রতিষ্ঠা করলেন ‘গ্র্যাভিটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন’। কীভাবে একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাকে হারানো যায়, এটাই তখন তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। যেভাবেই হোক বানাতে হবে এমন এক যন্ত্র, যা কাজ করবে মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে। একের পর এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা আয়োজন করলেন নতুন ভাবনাচিন্তার জন্য। ‘মাধ্যাকর্ষণবিরোধী’ শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য থাকবে বড়ো অঙ্কের পুরস্কার।
কিন্তু কোনো উৎসাহই দেখা গেল না বিজ্ঞানমহল থেকে। কিছুটা হাস্যকরভাবে উড়িয়ে দেওয়া হল ব্যাবসনের পরিকল্পনা। শেষে তাঁর সহকারীর যুক্তি অনুসারে সামান্য বদলে দেওয়া হল প্রতিযোগিতার মূল বক্তব্য। মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াই নয়, বরং তাকে আরো ভালো করে বোঝার জন্য পাঠানো হোক প্রবন্ধ। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত চলে আসছে এই প্রতিযোগিতা। ১৯৭১ সালে প্রথম পুরস্কার যেতেন স্টিফেন হকিং। এছাড়া রজার পেনরোজ, জর্জ স্মুটের মতো বিজ্ঞানীদের নাম আছে পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায়।
ছয়ের দশকে ব্যাবসনের সংস্থার পক্ষ থেকে তেরোটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ করা হয় বিশেষ এক অনুদান। সঙ্গে পাঠানো হয় তেরোটি পাথরফলক। ভবিষ্যতের পড়ুয়াদের জন্য মাধ্যাকর্ষণের শক্তিকে আয়ত্ত, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের জন্য থাকবে ভাতার ব্যবস্থা। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই শেষ পর্যন্ত বরাদ্দ অর্থকে সঠিক খাতে ব্যবহার করতে পারেনি। শুধুমাত্র টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কসমোলজি’ বিভাগ আজও কাজ করে যাচ্ছে ব্যাবসনের স্বপ্নপূরণের জন্য।
মাধ্যাকর্ষণের বিরোধী কোনো যন্ত্র আবিষ্কার করা সম্ভব কিনা, তা সময় বলবে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বাস্তব হবে ব্যাবসনের স্বপ্ন। কিন্তু, তাঁর পরিকল্পনা অদ্ভুত এক নিয়মের জন্ম দিয়েছে টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজও যখন কোনো গবেষক ‘কসমোলজি’ বিভাগ থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন, তখন তাঁকে হাঁটু মুড়ে বসতে হয় সেই পাথরফলকের সামনে। অধ্যাপক তাঁর মাথায় ফেলে দেন একটি আপেল, ঠিক নিউটনের গল্পের মতো করে। আশা একটাই, যদি মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁকে কোনোভাবে উৎসাহিত করতে পারেন স্বয়ং নিউটন! সূত্র: প্রহর।
আপনার মতামত জানানঃ