বর্তমানে যে লড়াইটি চলছে তা আরেকটি বিশ্বযুদ্ধে নিয়ে যাবে বলে মনে হয় না। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো মাইকেল ই ও’হ্যানলোন বলেন, বর্তমানে যে সংকট ও যুদ্ধ চলছে তার মধ্যে যথেষ্ট আন্তঃসম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছি না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শক্তিশালী পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল।
রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরাইল-হামাস যুদ্ধে তার পরিণতি সম্পর্কে অনেকেই অবহিত। রাশিয়ার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র আছে। ইসরাইল এবং ইরানের হাতেও এই অস্ত্র আছে বলে মনে করা হয়। তবে এসব অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে না। বিশ্ববাসী জানেন, বোঝেন এই অস্ত্র ব্যবহার করলে কী পরিণতি হতে পারে।
গাজাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে ইসরাইল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দম্ভ করে ঘোষণা দিয়েছেন হামাসের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করার আগে কেউই যুদ্ধ বন্ধ করাতে পারবেন না। এই যুদ্ধে কমপক্ষে ২৩ হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছেন তিনি।
তারপরও অব্যাহতভাবে গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে তাকে সমর্থন দিয়ে বিতর্কিত অবস্থায় পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তাকে এই যুদ্ধে ইসরাইলকে সমর্থন দেয়া থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন কয়েকজন সিনেটর। বিশেষ করে এ বছরটা যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের। তাতে ডেমোক্রেট দল থেকে জো বাইডেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন।
যুদ্ধে সমর্থন তাকে পেছনে নিয়ে যেতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা। এরই মধ্যে ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। লেবানন, ইয়েমেন, ইরান, সিরিয়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে। হিজবুল্লাহ, হুতিরা হামলা শুরু করেছে। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এসব স্থানে, বিশেষ করে ইয়েমেনে হুতিদের অবস্থানস্থলে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইরান সতর্ক পা ফেলছে। সে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেই মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মক একটি যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে টালমাটাল করে দিয়েছে। বিশ্ব বাজার ব্যবস্থা, অর্থনীতি প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়েছে। করোনা মহামারির পর এই যুদ্ধ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে। বিশ্বে এমন কোনো দেশ নেই যেখানে এর প্রভাবে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেনি। তা সামাল দিতে দেশে দেশে ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দৃশ্যত রাশিয়ার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে চীন ও উত্তর কোরিয়া। তাইওয়ান নিয়ে এমনিতেই উত্তেজনা বিরাজমান যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে। তাইওয়ানকে নিজেদের বলে দাবি করে চীন। কিন্তু নিজেদেরকে সার্বভৌম একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করে তাইওয়ান। তাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে প্রয়োজনে জোর প্রয়োগ করার হুঁশিয়ারি বার বার দিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
চীন তাইওয়ানে যেকোনো রকম সামরিক অভিযান চালালে তাইওয়ানের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাইওয়ানকে সামরিক সহযোগিতা দিয়েছে। তাইওয়ানের আশপাশে আছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে যে বিরোধ আছে, তাতে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ওই অঞ্চল নিয়ে আঞ্চলিক বেশ কতোগুলো দেশের সঙ্গে চীনের দা-কুমড়ো সম্পর্ক।
জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন সহ আরও কিছু দেশ দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের ন্যায্য হিস্যা চায়। অন্যদিকে চীন চায় পুরো দক্ষিণ চীন সাগরকে তাদের করে নিতে। শুধু এখানেই তারা বসে আছে এমন নয়। তারা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। এ জন্য বেশ কিছু কৌশল নিয়েছে। আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে এ অঞ্চলের কিছু প্রতিবেশীর সঙ্গে দহরম মহরম বাড়িয়ে তারা এখানে তাদের প্রভাব বাড়াচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর, মালদ্বীপে তাদের আশীর্বাদপুষ্ট প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজু ক্ষমতায় আসায় এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব বাড়ছে। বিষয়টি মোটেও ভালো চোখে দেখছে না ভারত। উত্তর কোরিয়া একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বলছে- এমনও ক্ষেপণাস্ত্র তাদের হাতে আছে, যা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আঘাত করতে সক্ষম। এই যে বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা- এই উত্তেজনা থেকেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যেতে পারে। আবার কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এটাই। এরই মধ্যে তা শুরু হয়ে গেছে।
খুব বেশি আগের কথা নয়। কিছু আমেরিকান সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে আশঙ্কা বা ভয় করছিলেন। তারা মনে করছিলেন তিনি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে দেবেন। তার ক্ষমতার মেয়াদ শেষ। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগেনি। আবার তিনি হোয়াইট হাউজের দৌড়ে নেমেছেন। এবার তিনি বিশ্বযুদ্ধকে এড়ানোর জন্য ক্ষমতায় ফিরতে চান।
সম্প্রতি তহবিল সংগ্রহের একটি ই-মেইলে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কড়া সমালোচনা করে তিনি লিখেছেন, ক্রুকড জো’কে দেখে আমার হৃদয় সত্যিকার অর্থেই ভেঙে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনি সবচেয়ে দুর্বল এবং সবচেয়ে অযোগ্য প্রেসিডেন্ট। তিনি আমাদের দেশটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন। এক প্রচারণা সভায় ট্রাম্প বলেছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রতিরোধ করতে পারেন শুধু তিনিই।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়া ও ইউক্রেন, ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধ আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাকে জাগিয়ে তুলেছে। এ জন্য এর অন্ধকার দিক নিয়ে কথা বলেছেন ট্রাম্প। ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন চালানোর পর পর গত বছর একটি জরিপ চালায় আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল এসোসিয়েশন। তাতে দেখা যায়, প্রতি ১০ জন মার্কিনির মধ্যে প্রায় ৭ জন মনে করেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর্যায়ে আছি আমরা।
এতে উজ্জীবিত হয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মিত্ররা। তারপর থেকে এই প্রশ্ন আর ওই সংগঠন করেনি। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় আবার সেই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নভেম্বরে দ্য হিলকে একটি সাক্ষাৎকার দেন ভার্জিনিয়ার ডেমোক্রেট সিনেটর টিম কেইন। তিনি বলেন, ৩০ বছর ধরে প্রকাশ্যে কখনোই আমি একটি প্রশ্নের উত্তর দিইনি। এ সময়ে অনেক মানুষ আমার কাছে এ প্রশ্নটির উত্তর জানতে চেয়েছেন। প্রশ্নটি হলো এটা থেকে কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে?
এই আশঙ্কাকে শুধু ট্রাম্প একাই বাড়িয়ে তুলছেন এমন নয়। নভেম্বরে ট্রাম্পের দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী বায়োটেক উদ্যোক্তা বিবেক রামাস্বামী অনেকটা ট্রাম্পের ভাষায় কথা বলেন। তিনি মিয়ামিতে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বন্ধ কর’ র্যালিতে অংশ নেন। এর একদিন পর নিউজার্সিতে তৃতীয় বিতর্ক হয়। সেখানে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন ওই রাজ্যের গভর্নর ও প্রেসিডেন্ট পদে রিপাবলিকানদের মনোনয়ন প্রত্যাশী ক্রিস ক্রিস্টি। তিনি বলেন, শেষবারের কথা আমাদের স্মরণ করা উচিত। ইউরোপে যুদ্ধ থেকে আমরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। কয়েক বছর লেগেছিল আমাদের। তারপর হিটলারকে পরাজিত করতে ইউরোপে পাঁচ লাখ মার্কিন সেনা নিহত হন।
যুদ্ধের যুক্তি শুধু রিপাবলিকানদের নয়। বামপন্থি অনেক ব্যক্তি এ নিয়ে কথা বলেছেন। তারা গাজায় ইসরাইলের বোমা হামলার সমালোচনা করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা শুরু করেছেন ড. কর্নেল ওয়েস্ট। নভেম্বরে তার কাছে টাইম ম্যাগাজিন জানতে চায়- দ্বিতীয় মেয়াদে বাইডেন নাকি ট্রাম্প হবেন উত্তম বাছাই। জবাবে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে এর উত্তর দেন। বলেন, দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধের চেয়ে কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তম? আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের উদ্ধৃতি দেয়ার দীর্ঘদিনের অভ্যাস আছে জো বাইডেনের। গত বছর ইউক্রেনে যখন রাশিয়া আক্রমণ করে তখন সহযোগীদের তিনি বলেছিলেন, আমরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে এড়ানোর চেষ্টা করছি। তখন থেকেই এই বার্তাটি বার বার ব্যবহার করছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও তার সহযোগীরা।
ইউক্রেনে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত জন ই হার্বস্ট। তিনি বর্তমানে আটলান্টিক কাউন্সিলের ইউরেশিয়া সেন্টারের সিনিয়র পরিচালক। তিনি বলেন, শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়া উচিত বাইডেন প্রশাসনের। তিনি বলেন, সরকারের প্রাইভেট পরামর্শের ক্ষেত্রে এটা ভুল না। অবশ্যই আমরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চাই না। এর বিরুদ্ধে আমাদের বলতে হবে- এই যুদ্ধে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ আছে। আমাদের উচিত সেই গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থকে নিশ্চিত করা।
কিছু সংখ্যক বিশেষজ্ঞ মনে করেন আমরা অন্য রকম আরেকটি সংকটের দ্বারপ্রান্তে। বিশ্বযুদ্ধ কাকে বলা হবে তা নিয়ে ভিন্নমত আছে। সাধারণত বিশ্বযুদ্ধে দুটি বড় শক্তিধর দেশের দুটি ব্লক থাকে। তারা আধিপত্য বিস্তারের জন্য লড়াই করে। তাদের প্রতি পক্ষের প্রতি প্রচুর রাষ্ট্রের সমর্থন থাকে। জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক দু’জন লেখক পি ডব্লিউ সিঙ্গার এবং অগাস্ট কোল ২০১৫ সালে টাইম ম্যাগাজিনে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
তাতে তারা পূর্বাভাস দেয়ার চেষ্টা করেছেন যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেমন হতে পারে। পূর্বাভাসে তারা বলেন, ইউক্রেনের ভূমি গ্রাস করবে রাশিয়া, চীনের সঙ্গে সৃষ্ট উত্তেজনা বৃদ্ধি আরেকটি বৈশ্বিক লড়াইয়ে নিয়ে যেতে পারে বিশ্বকে। সেই লড়াই হবে আকাশপথে, সাইবার স্পেসে। তারা বলেন, বর্তমানে যে লড়াইটি চলছে তা আরেকটি বিশ্বযুদ্ধে নিয়ে যাবে বলে মনে হয় না। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো মাইকেল ই ও’হ্যানলোন বলেন, বর্তমানে যে সংকট ও যুদ্ধ চলছে তার মধ্যে যথেষ্ট আন্তঃসম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছি না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শক্তিশালী পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরাইল-হামাস যুদ্ধে তার পরিণতি সম্পর্কে অনেকেই অবহিত। রাশিয়ার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র আছে। ইসরাইল এবং ইরানের হাতেও এই অস্ত্র আছে বলে মনে করা হয়। তবে এসব অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে না। বিশ্ববাসী জানেন, বোঝেন এই অস্ত্র ব্যবহার করলে কী পরিণতি হতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ