ঢাকায় পৌষ সংক্রান্তির এই দিনকে বলা হয় সাকরাইন। ঢাকাই ভাষায় ‘হাকরাইন’। আদি ঢাকাই লোকদের পিঠাপুলি খাবার উপলক্ষ আর সাথে ঘুড়ি উড়াবার প্রতিযোগীতার দিন। সাকরাইন একান্তই ঢাকার,যুগের পরিক্রমায় তাদের নিজস্ব উৎসব। এটা বাংলাদেশের কোথাও পালিত হয় না। যা ঢাকার জনপ্রিয় ও দীর্ঘ সাংস্কৃতিক চর্চার ফল।
সাকরাইন শব্দটি সংস্কৃত শব্দ সংক্রাণ থেকে এসেছে। আভিধানিক অর্থ: বিশেষ মূহুর্ত। অর্থাৎ বিশেষ মূহুর্তকে সামনে রেখে যে উৎসব পালিত হয় তাকেই বলা হয় সাকরাইন। এই সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে দক্ষিন ও দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় অনেক দেশেই এই উৎসব পালন করে। তবে ভিন্ন ভিন্ন নামে। এই উৎসবের দুটো দিক আছে। একটি ধর্মীয় অপরটি সাংস্কৃতিক। আমি সংক্ষেপে ঢাকার সাকরাইনের উৎসমূল এবং এই দুটো দিক সম্পর্কেই বলবো।
ভারতীয় জোতিষ শাস্ত্র মতে, রাশিচক্র অনুযায়ী ১২টি রাশির ১২টি সংক্রান্তি আছে। এইরুপ মকর সংক্রান্তি সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে বোঝানো হয়ে থাকে। মকর সংক্রান্তি হল সেইক্ষন যাকে ঘিরে এ উৎসব পালিত হয়। সংক্রান্তির এই উদযাপন কবে থেকে চলে আসছে তা সুস্পষ্ট কোন তথ্য নেই। হতে পারে হাজার বা তারও আগের পুরনো এ মকর সংক্রান্তির মহাতিথি।
হিন্দু শাস্ত্র বলে, মহাভারতের সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাশ হয়ে শুভ শক্তির উদয় হয়েছিল। তাই মানা হয়ে থাকে। অন্য মতে, মকররাশির দেবতা শনির বাড়ি একমাসের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলেন তাই দিনটি বাবা-ছেলের সম্পর্কের একটা বিশেষ দিন হিসেবে ধরা হয়।
তবে বিজ্ঞান অনুযায়ী, সূর্যের গতি দুই প্রকার।উত্তরায়ণ ও দক্ষিনায়ন। ২১ শে ডিসেম্বর সূর্য উত্তরায়ন থেকে দক্ষিনায়নে প্রবেশ করে। এ দিন রাত সব থেকে বড় হয় আর দিন সব থেকে ছোট। এরপর থেকে দিন বড় আর রাত ছোট হতে শুরু করে। মাঘ থেকে আষাঢ় পর্যন্ত ছয় মাস উত্তরায়ন আবার শ্রাবন থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত ছয় মাস দক্ষিনায়ন। পৌষ মাসের এই সংক্রান্তিকে বলা হয় উত্তর বা মকর সংক্রান্তি। সূর্য এই দিন ধনুরাশি থেকে মকররাশিতে প্রবেশ করে, যা থেকেই মকর সংক্রান্তির উৎপত্তি।
সব ধর্মেই চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্রের প্রভাব আছে। তাদের জীবন,আচার,সংস্কার, বিশ্বাস ও উৎসব এইগুলোর প্রভাবাধীন। ধর্মীয় ভাবে ঢাকার হিন্দুরা বিশেষত্ব শাখারিবাজারের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত না খেয়ে থাকেন। কেউ মাঘের প্রথমদিন বাসার কাছে খোলা জায়গায় পৌষ সংক্রান্তির পুজা করে গুচ্ছ কাঠের গুড়িতে আগুন জ্বালিয়ে। নানা রকমের শাড়ি জড়িদার কাপড় পড়ে ছোটবড় সব বয়সের নারীরা আগুনের চারিদিকে পুজা সামগ্রী সাজিয়ে বসে বুড়াবুড়ির পুজা উৎযাপন করে পৌষ মাসকে বিদায় জানিয়ে মাঘকে গ্রহন করতে।
১৮৪০ সালে ঢাকায় জেমস টেলর তার রিপোর্ট এ বলেছেন “এ দেশে আর একটি শ্রেষ্ট আমোদের দিন হল মকর সংক্রান্তি বা পৌষ মাসের শেষদিন। এই দিনে হিন্দু জমিদারগন তাদের জমিদারিতে ব্রাম্মণ ও প্রজাবৃন্দকে আতিথিয়তা প্রদান করেন। উন্মুক্ত মাঠে ভোজ উৎসব হয়। বিতরন করা হয় চাল,গুড়,তেলের তৈরী পিঠা ও ডাবের পানি। এটি বাস্তুু পুজা নামে পরিচিত। এ উপলক্ষে বিক্রমপুরে কুস্তি,লম্বদান ইত্যাদি প্রতিযোগীতা হয়ে থাকে”। এখানে ঢাকার ঘুড়ির কথাটি কিন্তু আমরা এখনো পাইনি। এতো গেল সংক্রান্তির ধর্মীয় দিক। এবার আসি সাকরাইনের সাংস্কৃতিক উৎসবের দিকে।
আগেই বলেছি সাকরাইন ঢাকার বিশেষ ঘুড়ি উৎসব। আদিকাল থেকেই এ শহরে মানুষ ঘুড়িবাজ হিসেবে পরিচিত। এর অবশ্য কারনও রয়েছে। এখানে ঘুড়ি উড়ানোর পেশাদারিত্ব কারুকাজ ও কলাকৌশলে অবাক হয়ে ঐতিহাসিকরাও এর মুগ্ধতা প্রকাশ করে গিয়েছেন। ঢাকায় ঘুড়ির আগমনের ইতিহাস জানতে আপনাকে যেতে হবে বেশী দূরে নয় ভারতের নবাবী শহর লাখনৌ পর্যন্ত।
জানেন কি? লাখনৌ মোগল ও নবাবী খানাপিনা ছাড়াও আর কি দুটোর জিনিষের জন্য বিখ্যাত ছিল? এক সুর-সঙ্গীত আরেকটি ঘুড়ি। ঢাকার নায়েব নাজিম ও নবাবেরা ছিল এই কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। এক সময় স্হানীয় নবাবদের পৃষ্টপোষকতায় লখনৌর আকাশ রংবেরঙ্গের ঘুড়ি আর আতশবাজির আলোক সজ্জায় পূর্ন থাকত। ধনীরা স্বর্ণ ও রুপার ঝালর ও কারচুপি খচিত নাটাই এবং ঘুড়ি উড়াতেন। এ উৎসবকে পাতাংবাজী বলা হত। নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ’র সময় এই নামে দেখা যায়। আর ঘুড়ি উড়ানো উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় নবাব আসাফউদ্দৌলার সময় থেকে।
হিন্দু স্বাশিত শহরে তারা পৃষ্টপোষকতার মাধ্যমে সব সম্প্রদায়ের মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন। যা সার্বজনীন ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সমাজে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছিল। উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু মুসলিম সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা। ঢাকার শেষ নবাব গাজিউদ্দিন যিনি পাগলা নবাব নামে পরিচিত ছিলেন তার ঘুড়ি উড়াবার নেশা আর আহসান মন্জিলের নবাববাড়ীর ঘুড়ি প্রীতি শহরের সবার জানা। শীত মৌসুমের তিন মাস ঢাকার লোকদের বাৎসরিক ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগীতা ও বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল। ছিল না নিদিষ্ট কোন দিন। পৌষের শেষ দিনটাকেই তারা বেছে নিতেন ঘুড়ি উড়াবার শেষ মৌসুমী উপলক্ষ হিসেবে। আরও একটা উপলক্ষ পিঠাপুলি ও জামাই আপ্যায়ন।
ঢাকার ঘুড়িবাজরা নেমে পড়তো খোলা মাঠ ও মহল্লার ছাদগুলোতে। ঢাকার খোসবাসীদের ভাষায় ঘুড়ির এই প্রতিযোগীতাকে বলা হত হারিফি বা হারিফ। বিভিন্ন উপলক্ষেই তারা নামতো হারিফ খেলায়। ঢাকার নবাবরা ছিলেন এর মূল পৃষ্টপোষক। চকবাজার, শাহবাগ, পল্টন ময়দান (দিলকুশা), আরমানিটোলা মাঠ সহ সব উন্মুক্ত স্হানেই চলতো এই আয়োজন। তবে হারিফ খেলার কিছু নিয়ম কানুন ছিল। ইচ্ছে হলেই যে কোন ঘুড়ি আপনি কাটতে পারবেন না।
এই নিয়ম মেনেই প্রতিযোগীতায় বন্টন করা হতো পয়েন্ট। যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হতো বিজয়ী। পৌষ গেলে শীতটা বেশ জমাট বাঁধে। ঢাকার ঘরে ঘরে তখন রসালো পিঠা তৈরীর আয়োজন চলতে থাকে। শশুরবাড়ীতে জামাইকে পৌষ শেষে আমন্ত্রণ জানানো ঢাকাই রীতি। জামাই এলে তাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হত ঘুড়ি আর নাটাই। নতুন চালের পিঠা খেয়ে শুরু হত দিনব্যাপী ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব।
পুরান ঢাকায় শশুরবাড়ী থেকে জামাইদের নাটাই ও বাহারি ঘুড়ি উপহার দেয়া এবং পিঠাপুলির ডালা পাঠানো ছিল অবশ্যই পালনীয়। এই পিঠা ও খাবার বিলি করা হত আত্বীয় স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে।প্রতিযোগীতা চলত কার শশুরবাড়ী হতে কত বড় ডালা এসেছে। মুড়ির মোয়া,ভেজা বাকরখানি আর বাহারি সব পিঠা বানানোর ধূম পড়ত। জামাইদের সাথে এই ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগীতায় অংশ নিত বাড়ীর বালক,তরুন,যুবক ও মহল্লাবাসীরাও।
তবে জামাইদের জন্য ঘুড়ি খেলার ব্যাপারটা ছিল আত্মসম্মান ও এলাকার মর্যাদার প্রশ্ন! মহল্লার জামাইদের ঘুড়ি কাটাকাটি শেষে অর্থাৎ যার ঘুড়ি দিয়ে অন্যটা বাকাট্রা হয়েছে তাকে কাঁধে করে বাদকদল সহ সন্ধ্যার পূর্বে পুরো মহল্লায় চক্কর দেয়া হত। শহরের মানুষের মাঝে তৈরী করত উন্মোদনা এবং ঘুড়িকে কেন্দ্র করে বাঁধভাঙ্গা আনন্দের অনুসঙ্গ। এমন বাড়ী বা মহল্লা ছিল না যারা এই দিনে অংশীদার হতেন না। এবং তাদের বাড়ীতে নাটাই ঘুড়ির অস্তিত থাকত না।
পৌষের বিদায় ক্ষনটি অর্থ্যাৎ শেষদিন হল এই লড়াই ও পিঠাপুলি খাওয়ার উৎসবের দিন। আবার ঢাকার তাতিবাজার ও শাখারিবাজারের হিন্দু সম্প্রদায় এই ঘুড়ি খেলার উৎসবটি ১লা মাঘ মেনে একদিন পরে পালন করে। সন্ধ্যায় খেলা শেষ হলে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা ঘুড়ি নাটাই সব আগুনে পুড়িয়ে শুভক্ষনকে বরন করে নিত আর মুসলমানরা নাটাই চিলেকোঠায় তুলে রাখতো পরের উৎসবের অপেক্ষায়।
সন্ধ্যা নামতেই আকাশে শুরু হত পটকা আর আতশবাজির খেলা। বুড়িগঙ্গার তীর আলোকিত হয়ে উঠত আলো ঝলমলে রঙ্গীন আভায়। ৬০ দশকে যুক্ত হয় মাইকের দাপট। নবাবদের সময় পল্টনে ব্যান্ডের বাজনা বাজিয়ে দুইদলকে উৎসাহ যোগান দেয়া হত। বিবর্তন ও প্রযুক্তি যোগ করছে হাই পাওয়ার সাউন্ড সিস্টেম ও গান। বিরিয়ানি, খিচুরি, কালিয়াও বাদ যাচ্ছে না।
কালের ধারাবহিকতায় উৎসবে অনুসঙ্গের পরিবর্তন এলেও আমেজ ও আবেগটা কিন্তু এখনও প্রজন্মান্তরে রয়ে গেছে ঠিক আগের মতই। যা নাগরিক মনকে বিনোদিতই করত না রেখে যেত পরবর্তী পৌষে দেখা হবার প্রস্তুতির চ্যালেঞ্জ। সাথে নিয়ে যেত ঐক্য আর বন্ধুত্বের বার্তা। শত বছরের নানা সাম্প্রদায়িক দন্দ সংঘাত উত্তেজনার মাঝেও পৌষ সংক্রান্তি বা সাকরাইন এই শহরে হিন্দু মুসলিম সবার সার্বজনীন এক সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে আজও টিকে আছে। পালিত হচ্ছে ঐক্য ও বন্ধুত্বের প্রতীক হয়ে। যা সকলের অনুকরনীয় বটে।
লেখক সাদ উর রহমানের “উৎসবের ঢাকা” গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
আপনার মতামত জানানঃ