গত একযুগে বাংলাদেশের উন্নয়নের বড় মাপকাঠি অতিরিক্ত ব্যয়ে একগুচ্ছ মেগা প্রকল্প। তবে এর অধিকাংশই হয়েছে বিদেশি ঋণের টাকায়। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে প্রত্যাশিত মাত্রায় রাজস্ব আহরণ না হওয়ায় বিদেশি ঋণে তাই নির্ভরতা বেড়ছে। ফলে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দায়ের পরিমাণ।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পুঞ্জীভূত মোট ঋণের ২৭ শতাংশই নেয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংক থেকে। আর ২০ শতাংশ দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। আর এই তালিকায়, নতুন করে বড় উৎস হিসেবে সামনে আসছে উচ্চ সুদের চীন ও রাশিয়া। যাদের দখলে মোট ১৭ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের সবশেষ ঋণ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদেশি ঋণে নির্ভরতা গত এক যুগে বেড়েছে পৌনে ৪ গুণ। তবে বৃদ্ধির প্রবণতা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে ২০১৮ সাল থেকে পরের ৪ বছরে। যাতে বলা হয়, প্রতি ১ বছরে ধারাবাহিকভাবে দায় বেড়েছে ১৮ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত।
আর ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ৯৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে পরিশোধ করতে হবে ৭৫ বিলিয়নের ওপরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী বছরে বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া ঋণের দায় পরিশোধ করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই যা চাপ বাড়াবে অর্থনীতিতে। একই সঙ্গে চীন-রাশিয়ার মতো ব্যয়বহুল উৎস থেকে ঋণ বাড়ানোর প্রবণতা ঝুঁকিতে বাড়াতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির।
বাড়তি চাপ সৃষ্টি করতে পারে চলমান ডলার সঙ্কটে। তাদের পরামর্শ সংস্কারে মনোযোগী হওয়ার। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ না হওয়ায় পরিচালন এবং প্রকল্প ব্যয়ের জন্য সরকারকে হাত পাততে হচ্ছে বিদেশিদের কাছে।
পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের প্রদেয় বার্ষিক ফি ও শেয়ারে বিনিয়োগসহ হিসাব করলে দেনার বোঝা আরও বাড়বে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগামীতে ঋণ পরিষেবার দায়ভার আসছে। এটা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। রিজার্ভের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, এ থেকেই পণ্য আমদানি করতে হয়। আবার ঋণও পরিশোধ করতে হয়। সুতরাং, সেটা যেন না কমে-সেই ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।
ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের সভাপতি ড. কাজী খলীকুজজ্জামান আহমদ বলেন, আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় লাগে। এখান থেকে অর্থ পাচার হয়ে যায়। সেটাও উদ্বেগজনক।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১২ বছরে বাংলাদেশের ঋণ তিন গুণ বেড়েছে। অথচ বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সম্মিলিত বিদেশি ঋণের পরিমাণ ২০২২ সালে কমেছে। গত বছর নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ ৩ দশমিক ৪ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশের বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
এদিকে শুধু ঋণই বেড়েছে তা নয়; অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মতে, টাকার মান দুর্বল হওয়ায় চলতি অর্থবছরে বিদেশি ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধে বাজেট বরাদ্দের চেয়েও সরকারের ব্যয় প্রায় ১১ শতাংশ বাড়বে। ইআরডি’র বাজেট ব্যবস্থাপনা কমিটির সাম্প্রতিক এক সভায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে অতিরিক্ত ৪ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছেন। টাকার মানের অবনমনকে এজন্য প্রধান কারণ বলা হয়েছে।
আর অতিরিক্ত এই অর্থ যোগ করলে, এই অর্থবছরে সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধের অংক দাঁড়াচ্ছে ৪১ হাজার ৯৬ কোটি টাকায়, অর্থাৎ আগের অর্থবছরের চেয়ে বাড়বে ৫২ শতাংশ। এরমধ্যে সুদ পরিশোধ করা হবে ১৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, বাকিটা বরাদ্দ থাকবে আসল পরিশোধে। আগের অর্থবছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ২৬ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
ইআরডি’র সভায় বলা হয়েছে, বিদেশি ঋনের আসল পরিশোধে সংশোধিত বাজেটে অতিরিক্ত ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। মূল বাজেটের ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দের চেয়ে যা ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে সুদ-বাবদ অতিরিক্ত ২ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। যা মূল বাজেটের ১৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দের চেয়ে ১৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি।
গত অর্থবছরে ঋণের আসল পরিশোধে ব্যয় হয়েছিল ১৭ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারের মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৫৫ দশমিক ৬০২ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের শুরুতে যা ছিল ৬২ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোট ঋণের মধ্যে বহুজাতিক উৎস থেকে এসেছে অর্ধেকের বেশি। আর ১০ শতাংশ নিয়েছে বেসরকারি খাত।
ইআরডির একজন কর্মকর্তা জানান, অর্থবছরের শেষের দিকে প্রতি ডলার কিনতে ১১৫ টাকা লাগতে পারে এমন ধারণার ভিত্তিতে সংশোধিত বাজেটে অতিরিক্ত বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, চলতি বছরের বাজেটে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ডলারের বিনিময় দর ১০৪ টাকা ধরে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। কিন্তু, বর্তমানে বিদেশি ঋণ পরিশোধে সরকারের প্রতি ডলারে প্রায় ১১০ টাকা ব্যয় হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতেই এক ডলারের বিনিময় দর ছিল ৮৬ টাকা। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বাড়তে থাকে এই দর। বর্তমানে যা ২৮ শতাংশ বেড়ে, ১১০ টাকায় পৌঁছেছে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) পুরোটাই ঋণ নির্ভর। অভ্যন্তরীণ বা বাইরে থেকে নিতে হচ্ছে। এই কাঠামো চলতে পারে না। আমাদের পর্যাপ্ত রাজস্ব আহরণ করতে হবে। যাতে সেখান থেকে খরচ করেও কিছু উদ্বৃত্ত থাকে। পরে এ দিয়ে ঋণ শোধ করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিদেশি ঋণ পরিশোধে যে ব্যয় বাড়ছে, তার বড় অংশই বিনিময় হারের এডজাস্টমেন্ট করতে হচ্ছে বলে। এটা এড়ানো সম্ভব নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগের কারণ রয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ