গাজা উপত্যকার সীমান্তবর্তী ইসরায়েলি অঞ্চল কিবুৎজে অন্তত ৪০ শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। যারমধ্যে কয়েকটি শিশুর মরদেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন ছিল।
শনিবার (৭ অক্টোবর) ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। এরপর তারা কিবুৎজ শহরে প্রবেশ করে ব্যাপক হামলা চালান।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলোতে বলা হয়েছে, কিবুৎজের অনেক ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছেন হামাসের সদস্যরা। গতকাল মঙ্গলবার কাফা আযা কিবুৎজের ধ্বংসযজ্ঞ দেখাতে সেখানে কয়েকজন সাংবাদিককে নিয়ে যায় ইসরায়েলি বাহিনী। ওই ছোট্ট অঞ্চলটিতে প্রায় ৭০ জনকে হত্যা করেছেন হামাসের সদস্যরা।
ইসরায়েলি টিভি চ্যানেল আই২৪নিউজের সাংবাদিক নিকোল জেদেক বলেছেন, সেখানকার চিত্র ‘সত্যিকার অর্থে ভয়াবহ।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘কেউ আশা করেনি পরিস্থিতি এমন হবে। এসব সেনাদের কাছ থেকে আমি যেসব ভয়াবহ তথ্য শুনেছি। আমি আগেই যেটি বলেছিলাম, অন্তত ৪০ শিশুকে গার্নার থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের বিছানাগুলো উল্টানো ছিল। স্ট্রলগুলো ফেলে যাওয়া হয়েছে। সবগুলো ঘরের দরজা খোলা ছিল।’
এই সাংবাদিক জানিয়েছেন, কিবুৎজে হামাসের হামলায় ঠিক কতজন নিহত হয়েছেন সে বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। কারণ সেনারা এখনো মরদেহ উদ্ধার করছেন এবং সেগুলো গণনা করছেন। কিবুৎজ মূলত একটি কৃষিপ্রধান অঞ্চল।
এদিকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ফোর্সের (আইডিএফ) মেজর জেনারেল ইতাই বেরুভ কিবুৎজের পরিস্থিতিকে গণহত্যার সঙ্গে সামিল করেছেন।
তিনি বলেছেন, ‘এটি কোনো যুদ্ধ নয়। এটি কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নয়। এটি গণহত্যা। আপনি দেখুন শিশু, তাদের বাবা, তাদের মা, তাদের বেডরুমে এবং তাদের সুরক্ষিত রুমে, কীভাবে সন্ত্রাসীরা তাদের হত্যা করেছে।’
হামাস কী?
হামাস একটি ফিলিস্তিনি ইসলামি সশস্ত্র গোষ্ঠী যারা গাজা উপত্যকা শাসন করে। হামাস ২০০৭ সালে ইসরায়েলকে হঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসে। এরপর ইসরায়েলের সাথে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ করে তারা।
এই যুদ্ধগুলিতে হামাস ইসরায়েলের দিকে হাজার হাজার রকেট নিক্ষেপ করেছে এবং অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকেও ইসরায়েলের দিকে রকেট নিক্ষেপ করার জন্য উৎসাহ দিয়েছে। তারা ইসরায়েলে অনেকবার মারাত্মকভাবে হামলা পরিচালনা করেছে।
জবাবে ইসরায়েলও বারবার হামাসকে বিমান হামলার মাধ্যমে আক্রমণ করেছে এবং মিশরের সাথে একজোট হয়ে ২০০৭ সাল থেকে গাজা উপত্যকাকে অবরোধ করে রেখেছে। ইসরায়েল বলছে তারা দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই এই অবরোধ দিয়ে রেখেছে।
মূলত ইরান হামাসকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে থাকে, তারা হামাসকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়।
যদিও ইসরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি অন্যান্য অনেক প্রভাবশালী দেশ হামাসকে একটি ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ বলে ঘোষণা দিয়েছে। বিশেষ করে হামাসের সামরিক শাখাকে ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ বলে এসব দেশ।
ইসরায়েল গাজা এবং এর উপকূলীয় এলাকার আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ করে পাশাপাশি সীমান্ত দিয়ে কারা যাতায়াত করবে ও কী ধরনের পণ্য প্রবেশ করতে পারবে তা তদারকি করে।
কেন ইসরাইল ও হামাস যুদ্ধ করছে?
ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে পারস্পরিক উত্তেজনা নিয়মিত ঘটনা। তবে শনিবার হামাসের হামলা ছিল একেবারে অতর্কিত। কোন ধরনের আগাম সতর্কবার্তা পায়নি ইসরায়েল।
হামাস ইসরায়েলে এক সাথে হাজার হাজার রকেট নিক্ষেপ করে এবং অনেক হামাস যোদ্ধা সীমানা পার হয়ে ইসরায়েলি বসতিতে আক্রমণ করে। এতে অনেক ইসরায়েলি নিহত হয় এবং অন্যদের বন্দী করা হয়।
এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল তাৎক্ষণিকভাবে বিমান হামলা শুরু করে। বিশেষ করে হামাসের বিভিন্ন অবস্থান লক্ষ্য করে তারা এই বিমান হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করে।
কতটা নজিরবিহীন এই হামলা?
বিবিসির আন্তর্জাতিক সম্পাদক জেরেমি বোয়েন বলেছেন- “এটি গাজা থেকে হামাসের পরিচালিত সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী অভিযান এবং ইসরায়েলের একটি প্রজন্ম কোনদিন তাদের দেশ এমন গুরুতর আক্রমণের শিকার হতে দেখেনি।
হামাসের সশস্ত্র যোদ্ধারা গাজা-ইসরায়েলের সীমানার তারের বেড়া পার হয়ে ইসরায়েলি বসতির বিভিন্ন জায়গায় ঢুকে পড়ে।
পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭৩ সালে মিশর ও সিরিয়া ইসরায়েলে এই ধরনের আচমকা হামলা চালায়। এ ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের যুদ্ধ লেগে যায়। ওই হামলার ৫০তম বার্ষিকীর একদিন পরে এই নজিরবিহীন আক্রমণ চালায় হামাস। হামলার এই তারিখটি হামাসের নেতারা একটি স্মরণীয় দিন হিসেবেই মনে রাখবেন। ”
হামাসের হামলার পর কী হতে পারে?
হামাসের সশস্ত্র কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ ফিলিস্তিনি এবং অন্যান্য আরবদের “(ইসরায়েলের) দখলদারিত্ব দূর করতে” সশস্ত্র অভিযানে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিবিসির জেরুসালেমের সংবাদদাতা ইয়োলান্দ নেল বলেছেন, এখন একটি বড় প্রশ্ন হল অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুসালেম বা এই অঞ্চলের অন্যান্য ফিলিস্তিনিরা তার আহ্বানে সাড়া দেবে কিনা।
ইসরায়েল নিঃসন্দেহে একটি তীব্র যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখছে যাতে একাধিক সশস্ত্র গ্রুপ যুক্ত হতে পারে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি হবে যদি শক্তিশালী লেবানিজ সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহ এই যুদ্ধে অংশ নেয়।
এদিকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ব্যাপকভাবে সেনা মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছে।
পাল্টা আক্রমণ হিসেবে গাজায় তারা এখন তীব্র বিমান হামলা চালাচ্ছে। পাশাপাশি সেখানে স্থল অভিযানেরও ইঙ্গিত দিয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ