১৮৩১ সালের ৮ জুলাই আমেরিকার জর্জিয়াতে জন্মেছিলেন জন পেম্বারটন। পড়াশুনায় ছোটবেলা থেকেই ভাল ছিলেন। রিফর্ম মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন ফার্মাসি নিয়ে পড়বেন বলে। ১৮৫০ সালে পেয়ে গিয়েছিলেন ফার্মাসিস্টের ডিগ্রি আর লাইসেন্স। তাঁর স্বপ্ন ছিল মানুষের রোগমুক্তির জন্য, বিভিন্ন রোগের ওষুধ আবিষ্কার করা। সেই লক্ষ্যে সফলভাবে এগিয়েও চলেছিলেন জন পেম্বারটন।
কিন্তু সেইসময় দাসপ্রথা নিয়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল আমেরিকায়। গৃহযুদ্ধে জন পেম্বারটন লড়াই করেছিলেন জর্জিয়ার স্টেট-গার্ডের হয়ে। ‘ব্যাটল অফ কলম্বাস’-এর লড়াইয়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন তিনি। যন্ত্রণা কমাতে নিতে শুরু করেছিলেন মরফিন ইঞ্জেকশন। দিনে তিন চারবার করে মরফিন নিতে নিতে, মরফিনের নেশায় চূড়ান্তভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন জন পেম্বারটন।
তখনকার দিনেও মরফিন যথেষ্ট দামি নেশা ছিল। পয়সায় কুলাতে না পেরে এবং নেশার কবল থেকে নিজেকে সরিয়ে আনার জন্য পেম্বারটন চিবাতে শুরু করেছিলেন সহজলভ্য কোকা পাতা। এই কোকা গাছ থেকেই তৈরি হয় আরেক ভয়ঙ্কর ড্রাগ কোকেন। কোকা পাতা চিবালে নেশা হয়, কিন্তু কোকা পাতা অসম্ভব তেতো। মুখে রাখাই যায় না। তাই কোকা পাতাকে সামান্য উপাদেয় করার জন্য পেম্বারটন নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে কোকা পাতার নির্যাসের সঙ্গে বিভিন্ন উপাদান মেশাতে শুরু করেছিলেন। স্রেফ নিজের নেশার তাগিদেই।
একদিন এই ভাবেই তিনি কোকা পাতার নির্যাসের সঙ্গে মিশিয়েছিলেন ‘কোলা’ বাদামের গুঁড়ো। দিনের শেষে বাড়ির বারান্দায় বসে সিরাপটির স্বাদ নিয়েছিলেন জন পেম্বারটন। খেতে বেশ ভালোই লেগেছিল। পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় হুইস্কিতে সোডা ওয়াটার মেশাতে গিয়ে, নিজের খেয়ালেই ‘কোকা’ আর ‘কোলা’ বাদামের মিশ্রণটিতে সোডা ওয়াটার মিশিয়ে চুমুক দিয়েছিলেন। চুমুক দিয়েই চমকে উঠেছিলেন পেম্বারটন। প্রথম চুমুকেই বুঝে গিয়েছিলেন এই তরলটি আগামী দিনে পৃথিবী কাঁপাতে চলেছে এবং তিনি সোনারখনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
পেম্বারটন পরের দিনই বন্ধু উইলিস ভেনাবলের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। উইলিস ছিলেন একটি ওষুধের দোকানের মালিক। উইলিসকে ‘কোকা’ আর ‘কোলা’ বাদামের মিশ্রণটির স্বাদ নিতে অনুরোধ করেছিলেন পেম্বারটন, সোডা ওয়াটার মিশিয়ে। একবার চুমুক দিয়েই বন্ধু উইলিস আনন্দে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠেছিলেন। দুজনে ঠিক করেছিলেন মিশ্রণটিকে ব্যবসায়িক ভাবে বাজারে আনবেন।
কয়েক মাসের মধ্যে দুই বন্ধু মিলে ‘কোকা’ আর ‘কোলা’ বাদামের মিশ্রণকে ‘ব্রেন-টনিক’ জাতীয় ওষুধ হিসাবে বাজারে এনেছিলেন। কারণ মিশ্রণটি খেলে বেশ ফুরফুরে লাগে ও মানসিক অবসাদ কাটে। বাজারে আসার পর মিশ্রণটির এক গ্লাসের দাম ছিল পাঁচ সেন্ট। প্রখর ব্যবসায়িক বুদ্ধির পেম্বারটন কিন্তু প্রিয় বন্ধুকেও মিশ্রণটির ফর্মূলা জানাননি। মিশ্রণটি বানাতেন নিজের ল্যাবরেটরিতে।
বাজারে আসার কয়েকদিনের মধ্যে, ব্রেন-টনিক হিসেবে নয় বরং সোডা ফাউন্টেন ড্রিঙ্ক হিসেবেই হিট হয়ে গিয়েছিল পেম্বারটনের আবিষ্কার করা মিশ্রণটি। ড্রিঙ্কটি বাজারে হিট হতেই ড্রিঙ্কটির একটি নাম দেওয়ার প্রয়োজন পড়েছিল। বিজ্ঞাপন কোম্পানির মালিক ফ্র্যাঙ্ক ম্যাসন রবিনসন, এই সোডা ফাউন্টেন ড্রিঙ্কটির নাম রেখেছিলেন, ‘Coca-Cola’, মিশ্রণটির প্রধান দু’টি উপাদানের নামে। এইভাবে এসেছিল পৃথিবী কাঁপানো ব্র্যান্ড ‘কোকা-কোলা’। পেম্বারটন তৈরি করে ফেলেছিলেন the Coca-Cola Company।
মরফিন ছাড়ার উদ্দেশ্যে জন পেম্বারটন কোকাকোলা আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু আবিষ্কারের পরও মরফিনের নেশা ছাড়তে পারেননি। সেই নেশায় প্রায় দেউলিয়া হতে বসেছিলেন জন পেম্বারটন। সংসার চালাবার জন্য এবং নেশার টাকা যোগাড়ের জন্য তিনি কোকা-কোলার ফর্মূলা বেচতে শুরু করেছিলেন। বেচতে শুরু করেছিলেন কোম্পানির শেয়ারও। যদিও কোকা-কোলা কোম্পানির সিংহভাগ শেয়ার নিজের হাতেই রেখেছিলেন জন। যাতে তাঁর ছেলে চার্লি পেম্বারটন ভবিষ্যতে ব্যবসা করতে পারেন।
তবে কোকা-কোলার ফর্মুলা বেচলেও, তাঁর নিজস্ব ফর্মুলার পুরোটা নাকি কাউকেই জানাননি জন পেম্বারটন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, এই কোকাকোলা ভবিষ্যতে একদিন আমেরিকার জাতীয় পানীয় হবে। মাতিয়ে দেবে গোটা বিশ্বকেও।পেম্বারটনের ফর্মুলা নিয়ে, অন্য সফট ড্রিঙ্কস কোম্পানিগুলি বিভিন্ন ব্র্যান্ড এনে রমরমিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল। কিন্তু প্রথমে জন ও পরে তাঁর ছেলে চার্লি তাঁদের ব্যবসা তেমন জমাতে পারেননি।
অথচ জন পেম্বারটনের ছেলে চার্লি পেম্বারটনের কাছে কোকা-কোলা নামটির কপিরাইট ছিল। আসলে চার্লি ছিলেন অলস প্রকৃতির। ব্যবসা বাড়ানোর চেষ্টা বা ইচ্ছে তাঁর ছিল না। তাছাড়া চার্লিরও বাবার মত মরফিনের নেশা ছিল, সঙ্গে ছিল মদ ও আফিমের নেশাও। বাবাকে বুঝিয়ে, দ্রুত বেশি টাকা রোজগারের জন্য ১৮৮৮ সালে চার্লি তাঁদের কোকা-কোলা কোম্পানিকে বেচে দিয়েছিলেন ধনকুবের এসা ক্যান্ডলারকে। এসা ক্যান্ডলারের ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে the Coca-Cola Company হয়ে গিয়েছিল the Coca-Cola Corporation। খুবই অল্পদিনের মধ্যেই সেটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সফট ড্রিঙ্ক নির্মাতা ও বিক্রেতা কোম্পানি হয়ে উঠেছিল। জন পেম্বারটনের স্বপ্ন সত্যিই সফল হয়েছিল। আমেরিকা সহ সারা বিশ্ব জয় করেছিল ‘কোকা-কোলা’।
কিন্তু কোকা-কোলার আবিষ্কারকের পরিণতি হয়েছিল মর্মান্তিক। পাকস্থলীর ক্যানসারে ভুগে, ১৮৮৮ সালেরই আগস্ট মাসে, কোকা-কোলার আবিষ্কারক জন পেম্বারটন মারা গিয়েছিলেন। মৃত্যুর সময় তিনি নাকি প্রায় দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন, তবুও ছাড়তে পারেননি মরফিনের নেশা। জন পেম্বারটন মারা যাওয়ার মাত্র ছয় বছরের মধ্যে মারা গিয়েছিলেন চার্লি পেম্বারটনও। ভোগবিলাস আর সবধরনের নেশায় সর্বসান্ত হয়ে। অথচ পৃথিবীর সেরা ধনকুবের হতে পারতেন পিতা-পুত্র, কারন কোকা-কোলা নামের সোনার খনিটি তাঁদেরই হাতে ছিল। তবে পরিণতি মর্মান্তিক হলেও, কোকাকোলার জনক হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন জন পেম্বারটন। নিজের হাতেই নিজের জীবনের শোচনীয় পরিসমাপ্তি ঘটানোর পরেও।
আপনার মতামত জানানঃ