হোয়াইট স্টার লাইন একটি বিখ্যাত ব্রিটিশ শিপিং কোম্পানী। ১৮৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানীটি মূলত ব্রিটেন-অস্ট্রেলিয়া রুটের অনেকগুলো ক্লিপার জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করতো। যাত্রীবাহী জাহাজের দুনিয়ায় এই কোম্পানীটি অত্যন্ত প্রভাবশালী মূলত তাদের নানা রকম উদ্ভাবনের কারণে।
আর কুনার্ড(Cunard) ছিল সেই সময়ে তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানী। এই কুনার্ডই একসময় তাদের দিকে একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল Lusitania এবং Mauretania নামের দুটি জাহাজ তৈরি করে। এ দুটো জাহাজ ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে দ্রুতগামী যাত্রীবাহী জাহাজ। তাদের জাহাজ দুটির পাশে হোয়াইট স্টার লাইনের জাহাজগুলোকে নিছক কৌতুক মনে হতে লাগলো।
হোয়াইট স্টার লাইন কর্তৃপক্ষের তখন মাথায় হাত। এখনই কিছু একটা না করলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যাবে না। কোম্পানীর চেয়ারম্যান জে ব্রুস ইসময় আমেরিকার অর্থনীতিবিদ জে পি মরগ্যানের সাথে বৈঠকে বসলেন। জে পি মরগ্যানই মূলত পুরো প্রতিষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এসময় তার কাছে প্রস্তাব করলেন কিছু জাহাজ বানানোর জন্য যেগুলো আকার এবং সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়ে হারিয়ে দেবে কুনার্ডের জাহাজগুলোকে। গতির চেয়েও জাহাজের আকৃতি এবং জাহাজটি কতটা বিলাসবহুল সেটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার কাছে। এখান থেকেই মূলত হোয়াইট স্টার লাইনের অলিম্পিক ক্লাস জাহাজের যাত্রা শুরু যা তাদেরকে ইতিহাসে স্থান করে দিয়েছে। তারা এই অলিম্পিক ক্লাসের অধীনে তিনটি জাহাজ নির্মানের ঘোষণা দেয়। এগুলো হলো অলিম্পিক, টাইটানিক এবং ব্রিটানিক।
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মার্চ। ইন্টারন্যাশনাল মার্কেন্টাইল মেরিন কোম্পানির অর্থায়নে গ্রেট ব্রিটেনের বেলফাস্টের হারল্যান্ড এন্ড ওলফ্ শিপইয়ার্ডে শুরু হয় টাইটানিক জাহাজ তৈরীর কাজ। প্রকৃতপক্ষে টাইটানিক এবং অলিম্পিক দুটো জাহাজের নির্মাণকাজ একসাথেই শুরু হয়েছিল। জাহাজ দুটোর গঠন এবং ডিজাইনও ছিল মোটামুটি এক। ১৫,০০০ মানুষ কাজ শুরু করে সেই শিপইয়ার্ডে।
জাহাজ নির্মাণের এই পুরো কাজটি শ্রমিকদের জন্য যথেষ্ঠ বিপদজনক। কারণ এরকম বড় একটি স্ট্রাকচার দাঁড় করানো সেই সময়ের প্রেক্ষিতে খুবই কঠিন একটি কাজ। নানা রকম সতর্কতাও শেষপর্যন্ত নির্মাণ চলাকালীন সময়ে শ্রমিকদের প্রাণহানি থামাতে পারেনি। নয় জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় পুরো সময়টাতে। আর গুরুতরভাবে আহত হয় প্রায় ২৪৬ জন মানুষ। টাইটানিকের শুরুটা হলো মৃত্যু দিয়েই।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ২ এপ্রিল। একটি ইতিহাস রচিত হলো ঐদিন। শেষ হলো টাইটানিক তৈরীর পুরো কাজ। তখন পর্যন্ত জাহাজটি মানুষের দ্বারা নির্মিত সর্ববৃহৎ চলমান কোনো বস্তু! আর খরচ কত হয়েছিল টাইটানিক তৈরীর জন্য? টাকার অঙ্কটা নেহায়েত মন্দ নয়। প্রায় ৭.৫ মিলিয়ন (বর্তমান প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন) ডলার! তাও আবার ১৯১২ সালের হিসেব অনুসারে।
আমরা যদি এখন শিপইয়ার্ড থেকে তাকাই তাহলে প্রায় তিনটি ফুটবল মাঠের সমান এই বিশাল জাহাজটিকে মনে হবে কোনো ভাসমান সুরম্য অট্টালিকা। ৮৮২ ফুট ৯ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য, ৯২ ফুট ৬ ইঞ্চি প্রস্থ এবং প্রায় ১৭৫ ফুট উচ্চতার এই বিশাল জাহাজটির ওজন হচ্ছে ৪৬,৩২৮ টনের মতো! টাইটানিকের ডেক মোট দশটি, যার মধ্যে আটটি যাত্রীদের জন্য। তবে টাইটানিকের চারটি চিমনি ছিল সবচেয়ে নজরকাড়া ব্যাপারগুলোর একটি। এর মধ্যে তিনটি চিমনি ছিল সক্রিয় এবং চতুর্থটি ব্যবহার করা হতো বায়ু চলাচলের জন্য কিংবা বলা যায় খানিকটা সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য। কারণ যাত্রাপথে ৯২টি বয়লার এবং ১৬২টি ফার্নেস থেকে কয়লা পুড়বে দৈনিক ৬৫০ টনের মতো করে!
যাত্রা শুরুর আগেই ততদিনে বিখ্যাত হয়ে গেছে টাইটানিক। কারণ ব্যয়বহুলতা এবং চাকচিক্যের দিক থেকে সে ছাড়িয়ে গেছে তখন পর্যন্ত নির্মিত সকল জাহাজকে। তখনকার সময়ের সকল আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটেছিল এ জাহাজটিতে। ওয়্যারলেস বা তারবিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থা তখনও অতটা প্রচলিত ছিল না। কিন্তু টাইটানিকের বোট ডেকের কাছে ছিল বিখ্যাত মার্কনী রুম। যেখানে রেডিও অপারেটররা ২৪ ঘন্টা বার্তা পাঠাতো এবং গ্রহণ করতো। এছাড়া টাইটানিকের অভ্যন্তরে ছিল সুদৃশ্য সুইমিং পুল, জিমনেসিয়াম, স্কোয়াস খেলার কোর্ট (একধরনের র্যাকেট খেলা), ব্যয়বহুল তুর্কি বাথ, ডাইনিং রুম, ফটোগ্রাফি ডার্ক রুম, বিশাল এবং ব্যয়বহুল ক্যাফে এবং ফার্স্ট ক্লাস ও সেকেন্ড ক্লাস উভয় যাত্রীদের জন্য আলাদা বিশাল লাইব্রেরী।
এর বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাও ছিল খুবই উন্নত ধরনের। জাহাজের ফার্স্ট ক্লাসের জন্য তিনটি এবং সেকেন্ড ক্লাসের জন্য একটি সহ মোট চারটি লিফটের ব্যবস্থাও ছিল। সবথেকে উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটি ছিল তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের জন্য সুযোগ সুবিধা। তাদের কেবিনগুলো এবং ডাইনিং রুম দেখলে যে কারও চোখ কপালে উঠে যাবে।
মূল যাত্রা শুরুর আগে আরও একটি ধাপ পার হতে হবে টাইটানিককে। আর তা হলো ফিটনেস যাচাইয়ের জন্য সমুদ্র পরীক্ষা (Sea trial)। মোট কথা, জাহাজকে সাগরে নামিয়ে বিভিন্ন কারিকুরি দেখানো হবে আর কি। ১৯১২ সালের ২ এপ্রিল ভোর ৬ টায় কারিকুরি দেখানোর জন্য বেলফাস্ট থেকে আইরিশ সাগরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় টাইটানিক।
আপনার মতামত জানানঃ