বাংলাদেশ রেলওয়েতে বর্তমানে দুটি অগ্রাধিকারভুক্ত প্রকল্প চলমান। এর একটি পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, যার আওতায় নির্মাণ করা হচ্ছে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলপথ। অন্যদিকে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে।
রেলপথ দুটির কোনোটিই এখনো বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যেতে পারেনি। তাছাড়া প্রকল্পগুলো অর্থনৈতিকভাবে কতটা লাভজনক হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। এমন অনিশ্চয়তার মধ্যেই নতুন করে আরেকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ভাঙ্গা থেকে বরিশাল ও পায়রা বন্দর হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪১ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা।
জানা গেছে, মেগা প্রকল্পটির ওপর একটি প্রাক-উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (পিডিপিপি) এরই মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত দীর্ঘ ২১৫ কিলোমিটার নতুন রেলপথসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর নির্মাণকাল ধরা হয়েছে ২০২২-২৯ সাল পর্যন্ত।
পিডিপিপিতে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যা ব্যয় হবে তার ৩২ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা নেয়া হবে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে ঋণ হিসেবে। বাকি ৯ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহের প্রস্তাব করা হয়েছে। বৈদেশিক সহায়তার সম্ভাব্য উৎস হিসেবে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (সিএইচইসি) এবং চায়না রেলওয়ে ডিজাইন করপোরেশনের (সিআরডিসি) নাম উল্লেখ করা হয়েছে পিডিপিপিতে।
ভাঙ্গা-পায়রা রেলপথ নির্মাণে ২০১৬-১৮ সালে একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা বাস্তবায়ন করে রেলওয়ে। দক্ষিণ কোরিয়ার দোহা, স্পেনের টিপসা ও বাংলাদেশের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিডিসির জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠান দিয়ে করানো এ সমীক্ষায় রেলের ব্যয় হয় ৪৩ কোটি টাকা। সমীক্ষায় বলা হয়, অর্থনৈতিকভাবে প্রকল্পটি অনেক মূল্যবান এবং এটি হবে একটি আকাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ। প্রকল্পটির ইকোনমিক ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন (ইআইআরআর) ধরা হয়েছে ১৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য বলছে, প্রস্তাবিত ব্রড গেজ সিঙ্গেল লাইন রেলপথটির দৈর্ঘ্য ২১৪ দশমিক ৯১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৩৬ কিলোমিটার হবে উড়ালপথে (এলিভেটেড)। কুমার, কালিগঙ্গা, শিকারপুর, আমতলী, কীর্তনখোলা, পায়রা, পটুয়াখালী, আন্ধারমানিক, টিয়াখালী, খাপরা ভাঙা নদীর ওপর বড় সেতু নির্মাণের প্রয়োজন হবে।
পুরো রেলপথের জন্য গড়ে তোলা হবে ১৯টি স্টেশন বিল্ডিং। স্টেশনগুলো হবে বরইতলা, টেকেরহাট, মাদারীপুর, কালকিনি, গৌরনদী, উজিরপুর, বরিশাল এয়ারপোর্ট, বরিশাল, দপদপিয়া, বাকেরগঞ্জ, বদরপুর, পটুয়াখালী, কাকুয়া, আমতলী, পায়রা পোর্ট, পায়রা বন্দর ইয়ার্ড ১ ও ২, লেমুপাড়া এবং কুয়াকাটায়।
পরিকল্পনা কমিশনে থাকা প্রকল্পটির পিডিপিপি যাচাই-বাছাইরের পর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরির কাজ শুরু হবে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত ও অবকাঠামো বিভাগের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পায়রা বন্দর এখনো পুরোদমে চালু হয়নি। আর ফরিদপুর-বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত সড়ক প্রশস্ত করার একটি প্রকল্প চলমান। তাই এখনই রেলের এ প্রকল্পের কতটা প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তা পর্যালোচনা করে দেখা হবে।’
বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়েতে চলমান সবচেয়ে বড় প্রকল্পটি হলো ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ’। এটি নির্মাণে সরকারের খরচ হচ্ছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ২৬৭ কোটি ডলার বা ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে এক্সিম ব্যাংক অব চায়না। প্রিফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটের (পিবিসি) মাধ্যমে নেয়া এ ঋণের সুদহার ২ শতাংশ। গ্রেস পিরিয়ড ছয় বছর।
রিপেমেন্ট পিরিয়ড ২০ বছর। ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে ২০২৫ সাল থেকে। সুদসহ প্রতি বছর গড়ে সাড়ে ১৩ কোটি ডলার বা প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। এদিকে রেলপথটির ঢাকা-ভাঙ্গা অংশ আগামী ১০ অক্টোবর উদ্বোধনের কথা রয়েছে। যদিও পুরো প্রকল্পটি শেষ করতে ২০২৬ সাল পর্যন্ত সময় চেয়েছে রেলওয়ে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে তৈরি ১৭০ কিলোমিটার রেলপথে ট্রেন পরিচালনা করে সরকারের যে পরিমাণ অর্থ আয় হবে, প্রকল্পটির জন্য গ্রহণ করা ঋণের কিস্তির তুলনায় তা নগণ্য। এর ফলে বাড়বে ঋণ-জিডিপির অনুপাত, যা এক সময় বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তারা বলছেন, ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার পর রেলপথটি ‘আন্ডার ইউটিলাইজড’ থাকার একটা সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ রেলপথটি খুব বেশি ব্যবহৃত হবে না বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ১৮ হাজার কোটি টাকায় বাস্তবায়নাধীন চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণাধীন রেলপথটি আগামী অক্টোবরের শেষের দিকে উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। তবে এ রেলপথের অর্থনৈতিক সুফল নিয়েও শঙ্কার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমান দুর্বল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন করে মেগা প্রকল্প নেয়া হলে তা জটিল এবং অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত হবে বলে মন্তব্য করেছেন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অথনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘চলমান প্রকল্পগুলোর ঋণের দায় বাড়ছে, যা জটিল পরিস্থিতি তৈরি করছে। এমতাবস্থায় বড় প্রকল্প গ্রহণ কেবলই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এর মধ্যে অর্থনীতি খুব একটা নেই।’
চলমান মেগাপ্রকল্পগুলো দেশের অর্থনীতিতে কতটা অবদান রাখতে সক্ষম হবে, তা বাস্তবায়নের পর যথাযথ যাচাই-বাছাই করে নতুন প্রকল্প গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন ঘর গোছানোর সময়। রাজস্ব আদায় বাড়লে তখন এমন চিন্তা করা যেতে পারে। এখন মেগা প্রকল্পের ভার নেয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। বর্তমানে এ ধরনের প্রকল্প নিয়ে চিন্তা করাটা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যদিও বলছেন, দেশের সব জেলাকে রেলের আওতায় আনতে সরকারের প্রণীত মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। ভাঙ্গা-পায়রা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে কুয়াকাটার পর্যটক, বন্দর ব্যবহারকারী এবং আশপাশের সব জেলার মানুষ উপকৃত হবে।
এ বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ধারাবাহিকভাবে রেলের উন্নয়ন করে যাচ্ছে। রেল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, সিগন্যাল ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, বড় বড় সেতু নির্মাণের মতো কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। ভাঙ্গা-পায়রা রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগও এসব কার্যক্রমের অংশ।’ প্রকল্পটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে মনে করেন রেলপথমন্ত্রী।
আপনার মতামত জানানঃ