জানুয়ারি মাসের ২৩ তারিখ, ১৮৯৮ সাল। ব্রিটিশ ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ আর অউধের মুখ্য বাস্তুকার সি ডব্লিউ উডলিং ও ফৈজাবাদের কমিশনার ভিনসেন্ট স্মিথের নির্দেশ পেয়ে লক্ষ্ণৌ থেকে নেপালের তরাই অঞ্চলের দিকে রওনা দিলেন পূর্ণচন্দ্র মুখার্জী।
তিনি সেই সময়ে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পুরাতত্ত্ব বিভাগে কাজ করতেন। সেটা ছিল ওই বিভাগে তার দ্বিতীয়বার যোগদানের পর্ব।
পুরাতত্ত্ব বিভাগে প্রথম পর্বে যে পুরাতত্ত্ববিদ ড. এ ফুহয়ারের সহকারী ছিলেন মি. মুখার্জী, তারই অনুযোগে সেবারের চাকরী হারিয়েছিলেন পূর্ণচন্দ্র। অথচ, সেই পুরাতত্ত্ববিদেরই এক ‘আবিষ্কার’ নিয়ে উপরমহলে গুরুতর সন্দেহ হওয়ায় চাকরি হারাতে হয় ড. ফুহয়ারকে। আর সেই তথাকথিত আবিষ্কারের সত্যতা যাচাইয়ের এবং সঠিক তথ্যানুসন্ধানের দায়িত্ব পড়ে পূর্ণচন্দ্র মুখার্জীর ওপরে।
ফৈজাবাদের কমিশনার ভিনসেন্ট স্মিথ মি. মুখার্জীকে দায়িত্ব দেন প্রাচীন কপিলাবস্তু এবং গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী উদ্যানের সঠিক অবস্থান খুঁজে বার করার।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মি. স্মিথের লেখা ভূমিকা সহ মি. মুখার্জীর জমা দেওয়া রিপোর্ট বই আকারে ১৯০১ সালে প্রকাশ করে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া। বইটি ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক ওয়েবসাইটে আপলোড করে রেখেছে।
‘আ রিপোর্ট অন আ ট্যুর অফ এক্সপ্লোরেশান অফ দ্য অ্যান্টিকুইটিস ইন দ্যা তরাই, নেপাল দ্য রিজিওন অফ কপিলাবস্তু’ শীর্ষক ওই বইতে মি. মুখার্জী লিখেছিলেন, “কোনও বিরতি না নিয়ে একটানা পথ চলে নেপালি তরাইয়ের সদর শহর তৌলিভা-তে পৌঁছই আমি। পরের দিন নিগলিভা-এ গিয়ে মেজর ওয়াডেলের সঙ্গে দেখা করি। আমার অগ্রসর হওয়া সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেওয়া হয় সরকারি আদেশ অনুসারে। আমি গোরখপুরে ফিরে আসি।
পূর্ণ চন্দ্র মুখার্জী বলেন, “সরকারের কাছ থেকে নতুন একটি টেলিগ্রাম পেয়ে আমি আবার নেপালের দিকে রওনা দিই এবং তেসরা ফেব্রুয়ারি থেকে তিলাউরাকোট অঞ্চলে খনন কাজ শুরু করি এবং আশাপ্রদ ফলাফল পেতে শুরু করি। ছয় তারিখে আমি সাগরওয়াতে ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাই, যেটাকে ড. ফুহয়ার কপিলাবস্তু বলে চিহ্নিত করেছিলেন। আমি নিরাশ হই কারণ ওটা কপিলাবস্তু হতে পারে না। নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারি তিলাউরাকোটই বুদ্ধের পিতার শহর হওয়ার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি।”
হঠাৎই মেজর ওয়াডেল সব খনন কাজ বন্ধ করে দেন, কদিনের মধ্যেই সেই নির্দেশ আবার পাল্টিয়ে যায়। এই পর্যায়ে তিলাউরাকোট আর চিত্রা-দেই অঞ্চলে বড়মাপের খনন কাজ শুরু করেন মি. মুখার্জী।
“ভিনসেন্ট এ স্মিথের নির্দেশ অনুযায়ী আমি ১১ই মার্চ রুম্মিন-দেই-র দিকে রওনা দিয়ে পরের দিন সেখানে পৌঁছই,” সরকারের কাছে জমা দেওয়া রিপোর্টে লিখেছিলেন পূর্ণ চন্দ্র মুখার্জী।
তার ভাষায়, “জঙ্গল সাফ করে বড় ঢিপিটা নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করে দেখার পরে নেপালি কুলিদের খনন শুরু করতে কাজে লাগাই। খননের শুরুতেই আশার আলো দেখতে পাই। বেরিয়ে আসে বেশ কিছু ধ্বংসাবশেষ।
তিলৌরা এবং চিত্রা-দেইয়ের থেকে কম সাফল্য নয় এটা। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যা পাওয়া যায় খনন করে, তার মধ্যে ছিল মায়াদেবীর মন্দির। ভিতের ইঁটগুলোতে সুন্দর কারুকাজ করা ছিল। বেশ কিছু ছোট স্তূপ আর অন্যান্য নিদর্শনও বেরিয়ে আসে।“
বৌদ্ধ বর্ণনায় লুম্বিনী উদ্যানই হল এই রুম্মিন-দেই। ওই অঞ্চলে সম্রাট অশোকের স্থাপিত একটি স্তূপে খোদাই করা শিলালিপিতে জায়গাটিকে লুম্মিনী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মাগধী ভাষায় লিখিত ওই শিলালিপি দেখে পূর্ণচন্দ্র মুখার্জী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে রুম্মিন-দেই প্রাচীন লুম্মিনী বা লুম্বিনী।
“রুম্মিনি নামটার সঙ্গে লুম্বিনী বা লুম্মিনীর সাযুজ্য রয়েছে। ওই শিলালিপি মাগধী ভাষায় লেখা, যে ভাষায় শব্দের শুরুতে বা মাঝে ‘র’ থাকলে সেটা সংস্কৃতে ‘ল’ হয়ে যায়।”
হিউয়েন সাং-এর বর্ণনা অনুযায়ী উদ্যানের পাশ দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি ছোট নদী প্রবাহিত হত, যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘রিভার অফ অয়েল’ অর্থাৎ তেলের নদী বলা হত। এখন ওই নদীর নাম তিলার নদী।
বুদ্ধের জন্ম-বৃক্ষের দক্ষিণ দিকে একটি স্নান করার পুকুর ছিল, ওই বৃক্ষ থেকে যার দূরত্ব ফা হিয়েনের বর্ণনায় ২০ লি আর হিউয়েন সাংয়ের বর্ণনায় ২৫ লি। জন্ম-বৃক্ষের ভাস্কর্যগুলি ২৫ লি দূরেই এখনও দেখা গেছে।”
‘লি’ প্রাচীন চৈনিক দূরত্ব মাপার একক। সাধারণভাবে এক ‘লি’ ৫০০ মিটার বা এক মাইলের এক তৃতীয়াংশের সমান। এছাড়াও হিউয়েন সাংয়ের লেখায় সম্রাট অশোক স্থাপিত যে স্তূপের কথা রয়েছে, সেটিও খুঁজে পান মি. মুখার্জী।
এই চারটি প্রমাণের ওপরে ভিত্তি করেই মূলত সঠিক ভাবে খুঁজে পাওয়া যায় গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থানটি। ভিনসেন্ট স্মিথ লিখেছিলেন যে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান যে এটিই, সেটা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হল।
গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান হিসাবে যে রুম্মিন-দেই বা লুম্বিনী নিশ্চিতভাবেই প্রমাণিত হলেও ভারতের উত্তরপ্রদেশের পিপরাওয়া-ও দাবী করে যে সেখানেই জন্মিয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। এই জায়গাটি নেপাল এবং তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের সীমান্তের খুবই কাছে অবস্থিত। সেখানেও বৌদ্ধ ধর্মের অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। সেই এলাকাগুলিতে নিজে গিয়েওছিলেন পূর্ণচন্দ্র মুখার্জী।
ওইসব নিদর্শনের বেশ কিছু সেই সময়ে কলকাতা মিউজিয়াম, যার নাম তখন ছিল ‘কলিকাতা পুরাদ্রব্যালয়’-তে রাখা হয়েছিল। সেই মিউজিয়ামই বর্তমানে ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম। চীনা পরিব্রাজকদের বর্ণনা অনুযায়ী কিছু মিল পিপরাওয়াতে পাওয়া গেলেও অমিল ছিল অনেকই।
তাই পূর্ণচন্দ্র মুখার্জী এবং তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভিনসেন্ট এ স্মিথ নিশ্চিত হয়েছিলেন যে প্রাচীন কপিলাবস্তু ছিল নেপালের তিলাউরাকোটের রুম্মিন-দেইতেই।
আপনার মতামত জানানঃ