বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) তাদের ‘বাজেট স্বল্পতার কারণে’ বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের জন্য পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না বলে তাদের নিশ্চিত করেছে।
এর ফলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশগুলো থেকে পর্যবেক্ষক আসবে কি-না তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে ইইউ’র প্রাকনির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের রিপোর্টের ভিত্তিতেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসিকে বলছেন যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিদ্ধান্তে এটি পরিষ্কার যে বাংলাদেশে নির্বাচনের পরিবেশ নেই-এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণিত।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলছেন জনগন নির্বাচনে অংশ নেবে এবং বিদেশী কেউ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসবে কি-না তার কোন গুরুত্ব তাদের কাছে নেই।
তবে একজন বিশ্লেষক আশংকা প্রকাশ করে বলছেন ইইউ’র সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী অন্যদেরও নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করতে পারে।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রেরও একটি প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। মূলত এ দলটির রিপোর্টের ওপর নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষক বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসবে কি-না।
এর আগে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বাংলাদেশ বিষয়ে যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলো সেখানেও মানবাধিকারের পাশাপাশি বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন প্রসঙ্গ এসেছিলো এবং তখন অবাধ বাজার সুবিধা (ইবিএ) বাংলাদেশের জন্য অব্যাহত রাখা যৌক্তিক কী-না সেই প্রশ্নও তোলা হয়েছিলো।
তখনই অনেকে আশংকা করছিলেন যে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবের ধারাবাহিকতায় নির্বাচন নিয়ে ‘শক্ত’ কিছু পদক্ষেপ ইইউ’র তরফ থেকে আসতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আসাটা যেমন অন্যদের উৎসাহিত করতো তেমনি না আসাটাও অন্যদের নিরুৎসাহিত করবে।
“এখনো সুযোগ থাকলে সংশ্লিষ্টদের উচিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের আপত্তির জায়গাগুলো সম্পর্কে জেনে সেগুলো নিরসনে ব্যবস্থা নেয়া।”
কী বলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল বক্তব্য হলো তারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য পূর্ণাঙ্গ দল পাঠাবে না, তবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সব প্রচেষ্টাকে তারা সহায়তা করবে।
নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম দুপরে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ইইউ এ সম্পর্কিত একটি ই-মেইল ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে এবং মন্ত্রণালয় থেকে সেটি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে পাঠানো হয়েছে।
তিনি জানান ইইউ তাদের ই-মেইলে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের বাজেট স্বল্পতার কথা উল্লেখ করেছে।
যদিও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে যে বাজেট স্বল্পতার প্রসঙ্গ ছাড়াও ইইউ আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ করার বিষয়টি পরিষ্কার হয়নি বলেও ই-মেইলে উল্লেখ করেছে।
তবে এ চিঠিতে ইইউ বলেছে যে বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হওয়াটা নিশ্চিত করতে তারা সব প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করবে।
অর্থাৎ নির্বাচন কতটা অবাধ ও সুষ্ঠু হয় তা নিয়ে সংশয় রয়েছে তাদের মধ্যে। আবার সুষ্ঠু নির্বাচনের গ্যারান্টি না পেলে বিরোধী দল বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিবে কি-না তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
এর আগে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠায়নি ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছিলো । আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও ওই নির্বাচনে ‘নজিরবিহীন ভোট কারচুপি’র অভিযোগ রয়েছে।
আরও চাপ আসছে?
নির্বাচনের প্রায় তিন মাস আগেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত সরকারের ওপর আরও চাপ তৈরি করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই নানা ভাবে নির্বাচনের বিষয়ে সরকারের ওপর চাপ দিয়ে আসছে।
বিশেষ করে নির্বাচনকে সামনে রেখে আগেই বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণা সরকারকে আগেই বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে বলে মনে করা হয়।
এ নিয়ে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারেই তিনি বলেছেন ‘যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তার সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না’।
ওদিকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো ইস্যুগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ বরাবরই একই সূরে কথা বলে থাকে। সে কারণেই ধারণা করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রও তাদের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অনুসরণ করতে পারে।
আর সেটি হলে নির্বাচনের প্রস্তুতির আগেই বড় ধরণের চাপ তৈরি হবে – সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর। বৃহস্পতিবারও ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য তাগিদ দিয়েছেন।
সব মিলিয়ে নির্বাচনের আগে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর আরও চাপ তৈরি হচ্ছেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আপনার মতামত জানানঃ