মানুষটি বড়ো চুপচাপ। সেভাবে মিশতে চান না কারোর সঙ্গে। তবে পরিচিতরা বলেন, তিনি নাকি এমনিতে রসিক। সঙ্গী বলতে কয়েকটি বিড়াল। রাশিয়াতে বিড়াল পোষার ব্যাপারটি তখনও খুব একটা প্রচলিত ছিল না। একদিন তিনি লক্ষ করছিলেন পোষ্যগুলির ইঁদুর ধরার পদ্ধতি।
অনেকক্ষণ আক্রমণ করে অবশেষে নিজেদের আয়ত্তে এসেছে একটি ইঁদুর। কিন্তু সুযোগ পেলেই পালাবে আবার। মা বিড়ালটি ইশারা করল বাচ্চাটিকে। আর সেই শব্দ শুনে চমকে গেলেন মানুষটি। ইউরেকা! এত দিনে হাতের মুঠোয় পাওয়া গেল সমাধান।
মানুষটির নাম ইউরি নোরোজোভ (Yuri Knorozov)। পেশায় ভাষাতাত্ত্বিক ও লিপিবিষারদ। দীর্ঘ গবেষণা করেছেন দক্ষিণ আমেরিকার ঐতিহাসিক মায়াসভ্যতার লিপি পাঠোদ্ধার বিষয়ে। সোভিয়েতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘স্কুল অফ মায়ান স্টাডিজ’। তিনিই প্রথম মায়ালিপিতে ‘সিলেবিক’ পদ্ধতির অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন, যার সাহায্যে অনেক ধাপ এগিয়ে যায় পাঠোদ্ধারের কাজ।
অথচ, তাঁর গবেষণার বেশিরভাগ সময়টিই কেটেছে রাশিয়ার গবেষণাগারে। মায়াসভ্যতার কেন্দ্রভূমি মেক্সিকো ও গুয়াতেমালা-তে যাওয়ার সু্যোগ হয় বহু পরে।
তখন তাঁর বয়স প্রায় সত্তর। কিছুদিন আগেই ভাঙা পড়েছে বার্লিনের দুর্গ। টুকরো টুকরো হয়ে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। মুক্তি পেয়েছে তাঁর জন্মভূমি ইউক্রেন। সমগ্র বিশ্বের রাজনীতিতে চলছে পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এবার তিনি যেতে পারবেন হাজার-হাজার কিলোমিটার দূরের দক্ষিণ আমেরিকায়।
সারাটা জীবন কেটে গেছে মায়াসভ্যতার চর্চা নিয়ে কেটে গেলেও সোভিয়েত সরকারের বিধিনিষেধের কারণে মেক্সিকো যাওয়ার অনুমতি পাননি। ততদিনে মায়ালিপি সংক্রান্ত তাঁর বিখ্যাত গবেষণাগুলি প্রকাশিত হয়ে গেছে। প্রথমদিকে যথেষ্ট পরিচিতি না পেলেও, পরে বিশেষজ্ঞরা তাঁর সঙ্গে একমত হতে বাধ্য হন।
কিন্তু যা শতাব্দী ধরে রহস্যের খাসমহল হয়ে রয়েছে, সেই মায়ালিপিকে পাঠোদ্ধার করলেন তিনি কীভাবে? সশরীরে তো কখনও হাজিরই হতে পারেননি সেখানে। গল্পে বিড়ালের অনুপ্রবেশ ঘটে তখনই।
প্রচলিত যে, ইঁদুর ধরার সময়ে তাদের ইশারা থেকেই নাকি ‘সিলেবিক’ পদ্ধতি নিয়ে কাজ করার ভাবনা আসে। পোষা বিড়ালটির নাম ছিল অ্যাসপিড। ভালোবেসে ডাকতেন আসিয়া (Asya) বলে। তাকে নিয়ে গল্প কিন্তু এখানেই শেষ নয়। গ্রন্থে সহলেখক হিসেবে তিনি জুড়ে দেন আসিয়া-র নাম। প্রকাশনা সংস্থাও এরকম অদ্ভুত আবদার মানতে রাজি নয়। অগত্যা বাদ দিতে হল বিড়ালটির নাম।
এরপর এল ছবির পালা। ইউরি কোলে বিড়ালটি নিয়ে তোলা একটি ছবি পাঠান।
দুজনেই ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে। ইউরি-র চোখেমুখেও যেন বিড়ালসুলভ ভঙ্গি। প্রকাশক ছবিটি ছাপলেন, তবে আসিয়ার অংশটি বাদ দিয়ে। রাগের নাকি ভাষাতাত্ত্বিকের মুখে ভাষা জোগায়নি। যদিও পরে বিখ্যাত হয়ে যায় আসিয়া-কে সঙ্গে নিয়ে তোলা ছবিটিই। তবে গল্পগুলিতে অতিরঞ্জনের ভাগটিই বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউরি বইয়ের সহলেখক হিসেবে আসিয়া-র নাম দিয়েছিলেন, সেটা সত্যি। কিন্তু সে নেহাতই তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসিকতার ঢং-এ। এবং সেটা ছিল শুধু পাণ্ডুলিপিতেই। প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে দ্বন্দ্বের ব্যাপারটি সম্ভবত গুজব। আসলে মায়াসভ্যতার গল্পগুলিতে জাগুয়ারের মতো প্রাণীর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, আবার রাশিয়ায় বিড়াল পোষার মতো ঘটনাগুলি জড়িয়ে তৈরি হয়েছে আসিয়া-র কিংবদন্তি।
পরবর্তীতে ইউরি মেক্সিকো-তে গিয়ে পেয়েছেন প্রভূত সম্মান। মনে হয়েছিল, এই দেশের বুকেই রয়েছে তাঁর হৃদয়। ১৯৯৯-তে মৃত্যুর পর মেক্সিকোতে তো বটেই, রাশিয়াতেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাঁর মূর্তি। আর সবকটি মূর্তির মধ্যে একটি মিল। ক্রূর চোখে দাঁড়িয়ে আছেন ইউরি। আর তাঁর কোলে আসিয়া। গল্পের বিড়ালকে আর কোনোদিন কোল থেকে নামানো যায়নি।
আপনার মতামত জানানঃ