২০২২ সালের বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের ২২টি ব্যাংক ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল টু রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেটস রেশিও (সিআরএআর) বজায় রাখতে ব্যর্থ হবে- যদি তাদের শীর্ষ ৩ ঋণগ্রহীতা খেলাপি হয়ে যায়।
ক্যাপিটাল টু রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেট রেশিও (মূলধন ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের অনুপাত) হচ্ছে একটি ব্যাংকের মূলধনের সাথে ব্যাংকটির রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেট বা ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ এবং বর্তমান ঋণের অনুপাত।
আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। ‘ব্যাসেল ৩’ নীতি অনুসারে, বাংলাদেশে ঋণদাতাদের তাদের রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেটসের ১০ শতাংশ বা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যে পরিমাণটি বেশি, সেটি সংরক্ষিত মূলধন হিসেবে রাখতে হবে। কোনো ব্যাংক নির্ধারিত এই পরিমাণ সংরক্ষণ করতে না পারলে, তা ওই ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষে প্রি-শক পরিস্থিতিতে ১১টি তফসিলি ব্যাংক ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সিআরএআর বজায় রাখতে পারেনি। এছাড়া, আরও ৫টি ব্যাংক বিদ্যমান সিআরএআর’র পাশপাশি ২.৫০ শতাংশ ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার (সিসিবি) বজায় রাখতে সক্ষম হয়নি।
এমন চাপের পরিস্থিতিতে, শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতাকে খেলাপি বিবেচনা করলে আরও ১১টি ব্যাংক ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সিআরএআর বজায় রাখার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হবে।
এছড়া, আরও অনেক ব্যাংকের সিআরএআর উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাবে। এই শকের কারণে বিশেষ করে, ১৯টি ব্যাংকের সিআরএআর ৫ শতাংশেরও বেশি পতনের সম্মুখীন হবে। আর আফটার-শক পরিস্থিতে ১০.১১ শতাংশ সিআরএআর নিয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীল থাকবে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
ব্যাংক উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ এবং মুনাফা থেকে প্রাপ্ত একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষিত থাকে। মূলধনের ঘাটতি থাকলে ব্যাংক তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। এছাড়া, বিদেশি ব্যাংকগুলো এসব স্থানীয় ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসা করার আগে তাদের মূলধন পরিস্থিতি বিবেচনা করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “একটি ব্যাংকের অবস্থা মূল্যায়নের অন্যতম চাবিকাঠি হল এর মূলধন। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মানে তার সম্পদের মান ভালো নয়। তাই, ব্যাংক ঋণ দিতে পারে না। এ ধরনের ব্যাংকগুলোকে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং তারা গ্রাহকের আমানত ঠিকঠাকভাবে ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়।”
নন-পারফর্মিং লোনের (এনপিএল) ৩ শতাংশ বৃদ্ধি বিবেচনা করে ব্যাংকগুলোর সামগ্রিক পারফর্মিং লোনের বিষয়টি পরীক্ষা করলে তা প্রতিটি ব্যাংকের পাশাপাশি পুরো ব্যাংকিং সেক্টরের মূলধন অনুপাত পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরে।
ব্যাংকিং খাতে এই শক বাস্তবে পরিণত হলে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে এনপিএল’র ৩ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকিং সেক্টরের সিআরএআর বিদ্যমান ১১.৮৩ শতাংশ থেকে কমে ৯.৮২ শতাংশে এসে ঠেকতো। প্রি-শক এবং আফটার-শক সিআরএআর এমনটাই ইঙ্গিত দেয়।
পরিস্থিতি এমন হলে, আরও চার ব্যাংক ন্যূনতম প্রয়োজনীয় মূলধন বজায় রাখতে ব্যর্থ হবে। এছাড়া, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যাংকের সিআরএআর ব্যাপকভাবে কমে যাবে। বিশেষ করে, ৩ শতাংশ এনপিএল বৃদ্ধির জন্য ৫ ব্যাংকের সিআরএআর ২৫০ বেসিস পয়েন্টেরও বেশি হ্রাস পাবে।
এছাড়া, কম্বাইন্ড শকের ক্ষেত্রে (এনপিএল বৃদ্ধিজনিত শক, ক্রেডিট শক, এক্সচেঞ্জ রেট শক, ইক্যুইটি প্রাইস শক, ইন্টারেস্ট রেট শক) ব্যাংকিং খাতে সিআরএআর বিদ্যমান ১১.৮৩ শতাংশ থেকে কমে ৭.৪৪ শতাংশে এসে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী বলেন, “কোনো গ্রাহকের বড় অঙ্কের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের প্রয়োজন হলে তাকে শেয়ারবাজারে তার কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করতে হয়। কিন্তু এখানে আমাদের ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। এতে ব্যাংকিং খাতের সার্বিক ঝুঁকি বেড়েছে।”
শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে কেন ব্যাংকগুলো মূলধনের ঘাটতির মুখোমুখি হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) বা অন্যান্য খাতে স্বল্প পরিমাণে ঋণ না দিয়ে, ব্যাংকগুলো কিছু গ্রাহককে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়ে ফেলেছে। এ কারণেই এমন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তারা। এ থেকে বোঝা যায়, ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স শিট সুগঠিত নয়।”
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্ট্রেস পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪টি ভালো অবস্থায় ছিল এবং ৭টি ছিল ‘মধ্যম’ অবস্থায়। এর বিপরীতে, একই সময়ে ১৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ছিল ‘দুর্বল’। সূত্র: টিবিসি।
এসডব্লিউএসএস ১৩৫৫
আপনার মতামত জানানঃ