বিশ্ব রাজনীতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং অস্থির অঞ্চলের একটির নাম মধ্যপ্রাচ্য। এখানে প্রতিটি যুদ্ধ বা সামরিক পদক্ষেপ একটি বিস্ফোরক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, যার ঢেউ পৌঁছায় বিশ্ব অর্থনীতি, কূটনীতি এবং নিরাপত্তার প্রতিটি স্তরে। এই বাস্তবতায় মার্কিন রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক অবস্থান পরিবর্তন একটি গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে।
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ট্রাম্প নিজেই ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির একজন কঠোর সমালোচক। তিনি প্রকাশ্যে ইরাক যুদ্ধকে ‘বড় ভুল’ বলে চিহ্নিত করেন এবং তৎকালীন রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী জেব বুশকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। এমনকি, সৌদি আরবে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, যারা জাতি গঠনের কথা ভেবে অভিযান চালিয়েছিল, তারা বরং আরও বেশি জাতি ধ্বংস করেছে। কিন্তু এখন, ট্রাম্পের কথাবার্তা এবং অবস্থান যেন উল্টো সুরে বাজছে। হঠাৎ করেই তিনি ইরান বিষয়ে আগ্রাসী হয়ে উঠেছেন। প্রশ্ন উঠেছে: কেন এই বদল?
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এর পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, ট্রাম্পের রাজনৈতিক চরিত্র এবং তার নেতৃত্বের ধরন যুদ্ধকে ‘বিজয়ের কাহিনী’ হিসেবে তুলে ধরতে আগ্রহী। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতা, মধ্যপ্রাচ্যে কিছু কৌশলগত সাফল্য, এবং ট্রাম্পের জেনারেল প্যাটনের প্রতি আকর্ষণ— সবকিছু মিলিয়ে তিনি হয়তো মনে করছেন, এবার ইরানে একটি ‘নিম্ন ঝুঁকির’ অভিযান চালানো সম্ভব, যেটি তাকে একজন নিরঙ্কুশ বিজয়ী হিসেবে তুলে ধরবে।
তবে ইরান লিবিয়া বা ইরাক নয়। এটি একটি বড় এবং সামরিকভাবে সুসংগঠিত দেশ, যার রয়েছে আঞ্চলিক প্রভাব, শক্তিশালী ধর্মীয় নেতৃত্ব এবং প্রতিশোধের দারুণ সামর্থ্য। সীমিত আকারে একটি হামলা হয়তো ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করতে পারে, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ। ইরান সরাসরি হামলা করতে পারে পার্শ্ববর্তী মার্কিন ঘাঁটিগুলোর ওপর। হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিয়ে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটের জন্ম দিতে পারে। এমনকি সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রেও হামলা হতে পারে।
সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো, ইরান হয়তো একটি বড় ধরনের সাইবার হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে, যা সরাসরি যুদ্ধের মাত্রা আমেরিকার ভূখণ্ড পর্যন্ত টেনে আনবে। আর যদি ইরানের বর্তমান ধর্মীয় সরকার পতনের দিকে ধাবিত হয়, তবে সেখানে সৃষ্টি হবে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক শূন্যতা। এ অবস্থায় দেশটি গৃহযুদ্ধ, জঙ্গি নিয়ন্ত্রণ বা বিদেশি হস্তক্ষেপের মুখোমুখি হতে পারে। তখন ৯ কোটিরও বেশি মানুষের একটি জাতি বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত হবে। এমন একটি পরিস্থিতি কেবল ইরান নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যকেই আগুনে জ্বালিয়ে দেবে।
ইসরাইলের দৃষ্টিভঙ্গি আবার একেবারে ভিন্ন। তাদের কাছে ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা অস্তিত্ব সংকটের সমান। নেতানিয়াহু অনেকদিন ধরেই মনে করেন, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করলে ইসরাইল এবং ইহুদি জাতির ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়বে। তাই তারা এই যুদ্ধকে যেকোনো মূল্যে দরকারি মনে করে। কিন্তু সমস্যা হলো, ইতিহাস বলছে— এমন যৌথ সামরিক অভিযান সাধারণত দীর্ঘ ও জটিল হয়ে পড়ে। গাজা কিংবা লেবাননে ইসরাইলি অভিযান দীর্ঘদিন চালালেও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে পুরোপুরি নির্মূল করা যায়নি। ইরানের ক্ষেত্রে সেই চ্যালেঞ্জ আরও জটিল, কারণ ইরান শুধুই একটি রাষ্ট্র নয়— এটি মধ্যপ্রাচ্যে একটি প্রভাবশালী আদর্শ ও রাজনৈতিক বলয়।
আমরা ভুলে যেতে পারি না যে, যুক্তরাষ্ট্র অতীতে ইরানে একাধিকবার হস্তক্ষেপ করেছে— ১৯৫৩ সালের সিআইএ-সমর্থিত অভ্যুত্থান, শাহের শাসনকে সমর্থন, ইরান-ইরাক যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনকে সহায়তা— এসব সবই ইরানিদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। এখন আবার যদি মার্কিন বিমানবাহিনী ইরানের আকাশে আগ্রাসন চালায়, তাহলে তা কেবল সামরিক নয়, আদর্শিক যুদ্ধেও রূপ নিতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের যুদ্ধচিন্তা কতটা যুক্তিযুক্ত? ট্রাম্প একজন এমন নেতা, যিনি বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রে বিভাজন সৃষ্টি করেছেন। তার পুরো রাজনৈতিক রণকৌশলই নির্মিত হয়েছে নিজের সমর্থকদের ঘিরে। এমন একজন নেতার পক্ষে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে যুদ্ধ পরিচালনা করা কি আদৌ সম্ভব? প্রশ্ন থেকেই যায়।
তাছাড়া ট্রাম্প গর্ব করে বলেন, তিনি কখনো নতুন যুদ্ধ শুরু করেননি। অথচ এখন তিনি এমন একটি সিদ্ধান্তের দ্বারপ্রান্তে, যা আবারও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়ে দিতে পারে— অনেকটা সেই পুরনো ভুল পথে ফেরার মতো। ইতিহাস বলে, অস্ত্র ব্যবস্থার ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যুদ্ধ শুরু করলে তা কখনো দীর্ঘমেয়াদে শান্তি আনে না— বরং জন্ম দেয় আরও বিশৃঙ্খলার।
আর তাই, যদি সত্যিই প্রথম মার্কিন বোমাটি ইরানের বুকে পড়ে, তাহলে সবার আগে আমাদের জানা দরকার— এরপর কী হবে? এই প্রশ্নের উত্তর না জানলে, এই যুদ্ধ আরেকটি বিপর্যয় ছাড়া কিছুই হবে না। এবং সেই দায় শুধু ট্রাম্পের নয়, গোটা বিশ্ব রাজনীতির ওপরই এসে পড়বে।
অথচ মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতির সম্ভাব্যতা মাথায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। একটির নেতৃত্বে থাকবে ইউএসএস নিমিট। অন্যটির নেতৃত্বে ইউএসএস কার্ল ভিনসন। এর মধ্যে ইউএসএস নিমিটজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জলসীমা ছেড়ে সোমবার মধ্যপ্রাচ্যের দিকে রওনা দিয়েছে। এটি সেখানে ইউএসএস কার্ল ভিনসনের সঙ্গে যুক্ত হবে, যা ইতিমধ্যে সাত মাস ধরে মোতায়েন অবস্থায় রয়েছে। তাহলে, একটি ইউএস নেভি ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ আসলে কী কী শক্তি নিয়ে আসে?
ক্যারিয়ার জাহাজ নিমিটজ এবং ভিনসন— উভয়ই নিমিট শ্রেণির পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০০ ফুট। ওজন প্রায় ১ লাখ টন। প্রতি জাহাজে ৫০০০-এর বেশি নৌসেনা কাজ করেন। ভিনসন জাহাজে থাকে এফ-৩৫ স্টিলথ ফাইটার জেট।
উভয় জাহাজেই থাকে এফ/এ-১৮ ফাইটার জেট, ইএ-১৮ ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার জেট, ই-২ বিমান সতর্কীকরণ ও নিয়ন্ত্রণ প্লেন, হেলিকপ্টার ইউনিট।
সহযোগী যুদ্ধজাহাজ গাইডেড-মিসাইল ডেস্ট্রয়ারস এবং/অথবা গাইডেড-মিসাইল ক্রুজার। তাদের দায়িত্ব থাকে বিমান হামলা প্রতিরোধ এবং সাবমেরিন ধ্বংসে সহায়তা করা। এতে যে টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র থাকে তা শত শত মাইল দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।
সাধারণত একটি ফাস্ট-অ্যাটাক সাবমেরিন গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত থাকে টর্পেডো ও ক্রুজ মিসাইল সজ্জিত সাবমেরিন। তবে নৌবাহিনী সাবমেরিনের অবস্থান প্রকাশ করে না।
কিন্তু এই সময়ে যুদ্ধ নয়, শান্তির কূটনীতি দরকার। কারণ ইতিহাসের প্রতি আমাদের একটি দায় আছে— যারা ইরাক, আফগানিস্তান বা লিবিয়ায় প্রাণ দিয়েছেন, তাদের সেই আত্মত্যাগ যেন আবারও এক নতুন অজুহাতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয়।
আপনার মতামত জানানঃ