বিভ্রান্তিকর বিবৃতি যাচাইয়ে টুইটার সম্প্রতি ফ্যাক্ট-চেকিং অপশন সংযোজন করেছে। এটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ট্রাম্পের বিরোধ বেঁধেছে এবং অপপ্রচারের বিষয়টিও সামনে এনেছে। টুইটার ও ট্রাম্পের মধ্যকার এ বিরোধ প্রযুক্তিগত অগ্রসরতার নেতিবাচক ফল মনে হলেও এটি আদৌ কোনো নতুন বিষয় নয়।
প্রাচীন গ্রিসেও সত্য, জ্ঞান ও গণতন্ত্র সম্পর্কে নিজস্ব কঠিন কঠিন বিতর্কের চল ছিল। আজকে প্রাচীন দার্শনিকরা বেঁচে থাকলে বলতেন, এটি কেবলই টুইট নিয়ে ঝগড়া নয়, বরং সত্যের মূল্য দেয়া সমাজে বাস করতে মৌলিক পছন্দ তৈরিবিষয়ক আমাদের প্রশ্নের মুখোমুখি করা একটি মুহূর্তও বটে। এ প্রশ্নের এথেনীয় অ্যাপ্রোচ প্রশ্নহীন ও অমূল্যায়িত অপপ্রচার ও মিথ্যা তথ্য কীভাবে খোদ গণতন্ত্রকেই নাজুক করতে পারে, তা দেখায়।
এ যুগের ‘ফেক নিউজ’ বা ‘ভুয়া সংবাদের’ বেশ আগেই সত্য সম্পর্কে গ্রিকদের চমকপ্রদ ও প্রাণবন্ত কিছু ধারণা ছিল। সক্রেটিস বলেছিলেন, পরম সত্য (সোফিয়া) জ্ঞেয় বা জানা সম্ভব এবং কেবল সত্য সম্পর্কে পারস্পরিক যোগাযোগ বিনিময়টাই সর্বোত্তম।
তার ছাত্র ও উত্তরসূরী প্লেটো আরো অগ্রসর হয়ে বলেছিলেন, দ্বান্দ্বিকতার (ডায়ালেকটিক) মাধ্যমে যেকেউ সত্যে পৌঁছতে পারে, যা প্রশ্ন করা এবং নিরীক্ষণের একটি পদ্ধতিকেই বোঝায়। সক্রেটিস ও প্লেটো উভয়ই প্রস্তাব করেছিলেন যে, প্রজ্ঞা সম্পূর্ণরূপে কেবল ‘সত্য’ ধারণেই নয়, বরং দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সম্পর্কে নিজের অজ্ঞতা সম্পর্কে সজাগ থাকার মধ্যেও নিহিত।
গণতান্ত্রিক এথেন্সের একজন মহান দার্শনিক হিসেবে আমরা প্লেটোকে এখনো স্মরণ করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি গণতন্ত্রের অনুরাগী ছিলেন না। কারণ তিনি মনে করতেন দ্বান্দ্বিকতার মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষই সত্যে পৌঁছাতে পারে না, কেউ কেউ পারে। তিনি দক্ষ বাগ্মিতা তথা রেটরিক নিয়েও ততটা ভাবিত ছিলেন না। তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন যে সত্যের জ্ঞান ছাড়া মানুষ শ্রোতাদের প্রভাবিত করতে ম্যানিপুলেশন ও ‘বেজ রেটরিক’ ব্যবহার করবে, যারা পার্থক্যগুলো ঠিক ধরতে পারে না।
এসব কারণে প্লেটো বিশেষত সোফিস্ট নামে পরিচিত বক্তৃতার কলাকৌশল শেখানো শিক্ষকদের ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন গর্জিয়াসের মতো গ্রিক বক্তৃতা বিশারদ। এরা ছিলেন স্বঘোষিত জ্ঞানী লোক, যারা অর্থের বিনিময়ে অভিজাতদের নৈতিকতা ও বক্তৃতাদান সম্পর্কে শেখাত। প্লেটোর দৃষ্টিকোণ থেকে সোফিস্টরা নিজের মক্কেলদের মন জয় করতে চতুর ভাষিক কৌশল ব্যবহার করত, কিন্তু সত্যানুসন্ধান মোটেই এগিয়ে নিত না। প্লেটো মনে করতেন, সোফিস্টরা নিজেরাও সত্য জানতেন না এবং তারা যাদের শেখাতেন, তারাও তা জানত না।
প্লেটোর সমালোচনার মধ্যে কিছু সত্যতা ছিল বটে, তবে বৃহত্তর অর্থে তিনি সঠিক ছিলেন না, পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন। নিজেদের দুর্বলতা সত্ত্বেও সোফিস্টরা একটি কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অত্যাবশ্যকীয় অংশীজন (প্লেয়ার) হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিলেন। কেন? কারণ বেশিরভাগ রাজনৈতিক সমস্যা প্লেটোর দ্বান্দ্বিকতায় সমাধান সম্ভব হয়নি। এর মাধ্যমে সত্য বেরিয়ে আসেনি, কিংবা এলেও তা সহজ ছিল না।
কাজেই সোফিস্টরা গণতন্ত্র চর্চার প্রয়োজনীয় দক্ষতা রপ্ত করেছিলেন। আর তা হলো, কীভাবে সত্য সম্পর্কে ঐক্যমতে পৌঁছাতে হয়, তার উপায় শেখা। কীভাবে শক্তিশালী যুক্তি তৈরি করতে হয়, নিজেদের পক্ষে শ্রোতাদের কীভাবে টানতে হয় এবং কীভাবে রুক্ষ্ণ-বিরোধপূর্ণ সমস্যা সমাধান করতে হয়, সেটি তারা মানুষকে শেখাতেন।
অন্যদিকে প্লেটোর দার্শনিক সত্য সন্ধানের বিপরীতে সোফিস্টদের লক্ষ্য ছিল ব্যবহারিক সত্য উদঘাটন (ফ্রনেসিস)। পাল্টা বয়ানগুলোর সপক্ষে তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে কীভাবে শক্তিশালী যুক্তি তৈরি করতে হয়, তারা তা শেখাত। সক্রেটিসের পরম জ্ঞেয় সত্য সন্ধানের বিপরীতে সোফিস্টরা সত্যকে ‘বিচিত্র মতামতের একটি জনগোষ্ঠীর নিজ বিশ্বাসের প্রতি একে অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা’ হিসেবে দেখতেন।
অবশ্যই হ্যাঁ, পরম সত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ব্যবহারিক সত্যকে (ফ্রনেসিস) অস্পষ্ট ও ধাঁধাময় মনে হয়। যখন শোনেন যে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর যুক্তি তৈরির সমার্থক হিসেবে আজকেও মানুষ ‘কুতর্ক’ শব্দটি ব্যবহার করে; তখন মনে হবে যেন কালের পরিক্রমায় খোদ প্লেটোই আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
কাজেই আজকের দিনের অপপ্রচার ও মিথ্যা তথ্য কি নিছকই কূটতর্ক? সম্পূর্ণ নয়। আমাদের গণতন্ত্র আসলে আধুনিক সোফিস্টদের সাদরে গ্রহণ করে, তাদের মূল্য দেয়। প্রাচীন গ্রিকদের মানদণ্ডে আজকের অধ্যাপক ও আইনজীবীরা দার্শনিকদের চেয়ে সোফিস্টদের মতো বেশি বিবেচিত হবেন।
অধ্যাপকেরা তাদের বিশেষায়িত শাস্ত্রে সাক্ষ্য-সাবুদের নিজস্ব ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকেন। আর নিজেদের মক্কেলদের পক্ষে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক যুক্তি তুলে ধরতে আইনজীবীরা ন্যায়শাস্ত্র ও বাগ্মিতার দক্ষতা কাজে লাগান। (এবং প্রাচীন সোফিস্টদের মতো উভয়ই নিজেদের প্রচেষ্টার জন্য অর্থ গ্রহণ করেন)।
প্লেটোর যেকোনো পরম ভক্তকে মোকাবেলা করতে হলে আমাদের অবশ্যই অধ্যাপক ও আইনজীবী উভয়েরই সত্য সন্ধানের ওপর সমান জোর দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষগুলোয় শিক্ষার্থীরা তাদের প্রশিক্ষকদের প্রশ্ন করে এবং যুক্তি দিয়ে তাদের চ্যালেঞ্জ করতে উৎসাহিত হয়। (আইনের অধ্যাপকেরা আসলে সক্রেটেসীয় পদ্ধতিতে পড়ায়!)
আদালত কক্ষগুলোয় সাক্ষীদের বিভিন্নভাবে নিরীক্ষা করা হয়, যাচাই করা হয় এবং জুরিদের ক্ষেত্রেও (তাদের বাছাই করা হয়, কারণ তারা ট্যাবুলা রাসা- ফাঁকা স্লেট) আশা করা হয় যে পাল্টামুখী পক্ষ-বক্তব্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মিথ্যাটা বোঝার চেষ্টার মাধ্যমে তারা সত্যে পৌঁছবেন।
আমেরিকা এরিস্টটলের আদৃত গণতন্ত্রের ভার্সনই সংহত করে, যা প্লেটো এবং সোফিয়েস্টদের মধ্যকার সবচেয়ে ভালো বিষয়গুলোরই সম্মিলন ঘটায়। এরিস্টটল ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, রেটরিক হলো (ফ্রনেসিস) ডায়ালেকটিকের (সোফিয়া) কাউন্টারপার্ট। সত্যানুসন্ধানের উভয় পদ্ধতি রাজনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধান এবং সত্যে পৌঁছানোর জন্য জরুরি।
তবে সমস্যা হলো যে অপপ্রচার এবং মিথ্যা তথ্য এসব মডেলের বাইরে লুকিয়ে থাকে। আমরা অপপ্রচার এবং মিথ্যা তথ্যের সম্মুখীন হলে প্রায়ই দেখি যে এর উৎপত্তি, যেকোনো ফলাফলে পৌঁছাতে এক্ষেত্রে ব্যবহৃত পদ্ধতি সাধারণত অস্পষ্ট থাকে। অপপ্রচার এবং মিথ্যা তথ্য অকাট্য যুক্তি যেমন হাজির করে না, তেমনি তা কঠোর নিরীক্ষণও উৎসাহিত করে না।
উল্লিখিত দুটি বিষয় সম্মতিবিহীন প্ররোচনা বৈ কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে, তথ্যের নতুন ভার্সন প্রদান করে এর মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা বা বিষয় লুকোনোর চেষ্টা করা হয়। যোগাযোগের এসব ধরন যুক্তির বিপরীতে প্রভাবভিত্তিক (ম্যানিউপুলেশন-বেজড) একটি সিদ্ধান্ত প্রদান করে থাকে। অপপ্রচার এবং মিথ্যা তথ্য একটি জগৎ সৃষ্টি করে, সত্য সন্ধানের একটি সম্মিলিত প্রয়াসের বিপরীতে যেখানে অবিশ্বাসকে বিশ্বাসঘাতকতা গণ্য করা হয়।
মোটা দাগে বলা যায়, অপপ্রচারের লক্ষ্য প্ররোচনা নয়, বরং এর লক্ষ্য হলো কমপ্লায়্যান্স নিশ্চিত করা। এটি সোফিয়া বা ফ্রনেসিস কোনোটাই কাজে লাগায় না। সেজন্য এটি কর্তৃত্ববাদীদের প্রিয় একটি যোগাযোগের ধরন। সত্যের অন্য সব দাবি প্রত্যাখ্যান করে আমরা যা বিশ্বাস করি এটি কেবলই তা দাবি করে। কোনো দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি ব্যবহারের পরিবর্তে সত্যানুসন্ধানের কিছু গোপন প্রক্রিয়া দাবিপূর্বক এটি পরম সত্যের অস্তিত্ব স্বীকার করার মতো একটি বিষয়।
কোনো সাক্ষ্য-যুক্তি উপস্থাপন ছাড়া কোনো কিছুকে ‘ভুয়া সংবাদ’ হিসেবে অভিযুক্ত করা নিজেই ভ্রমাত্মক। জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ উপন্যাসের ভাষায় এটি ‘স্বীয় চোখ-কানের সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যান করার’ সমতুল্য। ইচ্ছাকৃতভাবে উপস্থাপিত মিথ্যা তথ্যে নিহিত আনুগত্যের পরোক্ষ আকাঙ্ক্ষা গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক। যখনই সত্য অনুসন্ধান করার অঙ্গীকার করছি এবং এটি আবিষ্কারের পদ্ধতি সম্পর্কে সম্মত হচ্ছি, তখনই আমরা গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক ভিতের মৌলনীতিগুলো নির্ধারণ করে চলছি।
এই সম্মিলিত মূল্য ও বিশ্বাস আমাদের কেবল সামষ্টিক সমাধানে পৌঁছাতে সাহায্য করে না, উপরন্তু এমন এক বন্ধনে আবদ্ধ করে যা আমাদের সমাজের ঐক্যতান ধরে রাখে। যার ফলে সরকারগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হলে কিংবা কোনো নীতি প্রণয়ন করলে আমরা সহজেই তার সঙ্গে ভিন্নমতও পোষণ করতে পারি।
কাজেই ট্রাম্পের টুইটে টুইটার যখন তথ্যজুড়ে দেয়ার চেষ্টা করে, তখন প্রতিষ্ঠানটি খুব পুরনো ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিই ব্যবহার করছে, যা আমাদের প্রাচীন গ্রিকদের কাছে নিয়ে যায়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সত্য অনুসন্ধান ও তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে আমাদের নিজেদের এবং ফেলো নাগরিকদের একটি দায়িত্ব রয়েছে। এটি কোনো ব্যক্তি বা দল নয়, সম্মিলিত মূল্যবোধ ও উচ্চতর মূলনীতির প্রতি অনুগত হতে আমাদের উৎসাহিত করে।
তবে ন্যায্য যুক্তি ও সত্য উন্মোচনের বিপরীতে সিদ্ধান্তগ্রহণ পক্ষাবলম্বনভিত্তিক হলে উল্লিখিত মৌলনীতিগুলো ব্যাহত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ব্যক্তি বা কোনো দলীয় সম্পর্কের প্রতি আনুগত্যভিত্তিক বিশ্বাসগুলো প্রশ্ন করতে সহায়তা জোগানো তথ্যের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর। সূচনা বিন্দু হিসেবে একটি সম্মিলিত তথ্যগত বাস্তবতা ছাড়া বিবদমান ধারণাগুলোর এরিস্টটোলীয় আদর্শ বাস্তবায়ন এবং আমাদের সাধারণ ও যৌথ বিষয়গুলোয় ঐক্যমতে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
অপপ্রচারকারীরা- হোক সে প্রেসিডেন্ট বা অন্য সাধারণ কেউ, যখন মিথ্যার মুখে তথ্য জোগানোর যেকোনো প্রচেষ্টা ব্যাহত করার চেষ্টা করে, তখন তারা সত্যানুসন্ধানের মূল স্তম্ভগুলোও (কৌতূহল ও তর্ক-বিতর্ক) প্রত্যাখ্যান করে, যার ওপর একটি গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত প্রোথিত। যুক্তির বিপরীতে অভিযোগ এবং বোঝানোর বিপরীতে কমপ্লায়্যান্স গণতান্ত্রিক সংলাপের সঙ্গে বেমানান। প্রাচীন গ্রিকরা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বাইরে প্রশ্নহীন অপপ্রচার এবং মিথ্যা তথ্যকেও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আমাদেরও তাই করা উচিত।
এসডব্লিউএসএস/০৭০৫
আপনার মতামত জানানঃ