ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণ সাগরের মাঝামাঝি বসফরাস প্রণালীর এক গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল বাইজেন্টিয়াম। এটি ছিল মূলত একটি উপনিবেশ, যার গোড়াপত্তন করেছিল প্রাচীন গ্রিক। সেই সময়ে শহরটি গ্রিক ও পার্সিয়ানদের মধ্যে সীমান্তের কাজ করত। পরবর্তীতে শহরটি তার অবস্থানের কারণে ইউরোপ ও এশিয়া মাইনরের মধ্যে যোগাযোগের বেশ উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষ করে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে।
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য হয়ে ওঠে রোমান সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ প্রাচ্য অংশ, যা পাশ্চাত্য অংশের চেয়ে অনেক বেশিদিন টিকে ছিল। কনস্টান্টিনোপলকে নতুন রাজধানী করার সাথে সাথে আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ করেন কনস্টানটাইন। তিনি খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্মে পরিণত করেন ও অন্যান্য ধর্মের অনুশীলন একরকম নিষিদ্ধই করেন। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যই প্রথম শুধুমাত্র পার্থিব ক্ষমতা না, গীর্জা কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এই হলো প্রথম কনস্টানটাইনের প্রতিষ্ঠিত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য। এটি ৩৩০ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। এরপর অনেকে সম্রাট কনস্টানটাইনের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। আইরিনের ঘটনার সূত্রপাত পঞ্চম কন্সটানটাইনের সময়ে। ৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম কন্সটানটাইন আইরিনকে তাঁর পুত্রবধু করেন, রাজপরিবারে প্রবেশ ঘটে আইরিনের।
আইরিনের শৈশব সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। এথেন্সের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ৭৫২ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পরিবারের পরিচয় ইতিহাসে অস্পষ্টই থেকে গেছে। তবে তাঁর সৌন্দর্যের ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারিণী ছিলেন আইরিন। অনেকের মতে, শুধু এই কারণেই পঞ্চম কন্সটানটাইন আইরিনকে তাঁর পুত্র চতুর্থ লিওর জন্য নির্বাচিত করেছিলেন।
বিয়ের পরপরই আইরিন রাষ্ট্রীয় নীতিতে হস্তক্ষেপ শুরু করেন তাঁর স্বামী চতুর্থ লিওকে খোদাইকৃত মূর্তির ছবি (আইকন) বিনষ্ট থেকে বিরত রাখার চেষ্টার মাধ্যমে। কেননা খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর থেকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে বিভিন্ন মূর্তির অঙ্কিত বা খোদাইকৃত ছবির উপাসনা করা নিষিদ্ধ মানা হত। একদিকে আইরিন ছিলেন এসব আইকনের সমর্থক, অন্যদিকে লিও ছিলেন সেগুলো ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। ধর্মীয় এই মতভেদ থেকেই তাদের সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়।
বিয়ের এক বছর পরেই সম্রাজ্ঞী আইরিন এক পুত্রের জন্ম দেন, যার নাম রাখা হয় ষষ্ঠ কনস্টানটাইন। লিও জীবিত অবস্থাতেই পুত্র কনস্টানটাইনকে আইরিন তাঁর সহ-শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে তাঁর পরে তাঁর পুত্র ও পুত্রের বংশধরেরাই সিংহাসনে বসবে- এমনটাই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। এতে লিওর অন্যান্য ভাইয়েরা বেশ ক্রুদ্ধ হয়। তাঁর ভাই নিকেফোরাস তাদের মধ্যে অন্যতম।
বেশিদিন রাজত্ব করা ভাগ্যে ছিল না লিওর। ৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন তিনি। ৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে জ্বরে ভুগে মারা যান। অনেকেই ধারণা করেন, আইরিনই তাঁর স্বামীকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছিলেন। যদিও এমন কিছুর বাস্তব প্রমাণ কখনো পাওয়া যায়নি। লিওর মৃত্যুর পর দশ বছরের পুত্র কনস্টানটাইনের রাজপ্রতিনিধি হিসেবে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ক্ষমতার অধিকারী হন আইরিন।
পুত্রের সাথে সহ-শাসক হওয়ার সাথে সাথেই আইরিনকে পঞ্চম কনস্টানটাইনের অন্যান্য পুত্রদের রোষের মুখে পড়তে হয়। নিকেফোরাস আরো অন্যান্য ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সাথে নিয়ে আইরিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ও তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের চেষ্টা করে। এই চেষ্টায় সে বিফল হয় এবং তাকে ও তাঁর অন্যান্য ভাইদের জোরপূর্বক যাজকে পরিণত করা হয় যাতে তারা পরবর্তীতে আর সাম্রাজ্য দাবী করতে না পারে।
সহ-শাসক হিসেবে ক্ষমতায় যাওয়ার পরপরই আইরিন তাঁর পুত্রের সাথে ফ্র্যাংকিশ রাজা শার্লামেইনের কন্যার বিয়ে দেন নিজের অবস্থান আরো দৃঢ় করতে। সম্রাজ্ঞী হিসেবে আইরিনের প্রথম বড় পদক্ষেপ ছিল আইকন পূজাকে বৈধতা দেওয়া। ৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কনস্টান্টিনোপলের পাদ্রী চতুর্থ পলকে অব্যাহতি দিয়ে তুলনামূলক মধ্যপন্থী ও রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার অধিকারী টারাসিয়াসকে পাদ্রী নিযুক্ত করেন। তাঁর সহযোগিতায় ৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে গীর্জার একটি পরিষদ আহবান করে আইরিন আইকন ধ্বংসের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেষ্টা করেন।
সামরিক বাহিনীর অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিই বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। পুত্র কনস্টানটাইনও তাদের সমর্থন দেন। ফলে তখন সেই পরিষদের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। আইরিন সুকৌশলে সামরিক বাহিনীর ঐসব বিরুদ্ধকারী ব্যক্তিদের অন্যত্র পাঠিয়ে দেন বিভিন্ন সামরিক অভিযানের নামে এবং সেসব পদে নিজের বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের বহাল করেন।
৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে অপর একটি পরিষদ, যা সপ্তম সার্বজনীন পরিষদ নামে পরিচিত, যেখানে রোমান ক্যাথলিক ও প্রাচ্যের সনাতন গীর্জাগুলো একত্রিত হত নাইকিয়াতে। আইরিন সেই পরিষদে আরো ৩৫০ জন পাদ্রীর সম্মতিক্রমে আইকন পূজাকে বৈধতা দান করেন। এই কাজের জন্য পরবর্তীতে সনাতন গীর্জার অনুসারীদের কাছে তিনি সাধ্বীতে পরিণত হন।
পুত্র কনস্টানটাইনের সাথে তাঁর সম্পর্ক খুব ভালো ছিল না। পুত্র যতই বড় হচ্ছিল মায়ের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ ততই বাড়ছিল। বিশেষ করে কনস্টানটাইনের অমতেই তাঁর ও শার্লামেইনের কন্যার সম্পর্কের ইতি টেনে সন্তানের বিরাগভাজনে পরিণত হয়েছিলেন আইরিন। এরপর থেকেই ক্ষমতা একলা দখলের কথা ভাবতে থাকেন কনস্টানটাইন। ৭৯০ খ্রিস্টাব্দে ১৬ বছরের কনস্টানটাইনের হাতে ক্ষমতা পুরোপুরি হস্তান্তর করতে না চাওয়ায় আইরিনের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান হয় ও তাকে সহ-শাসক পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। কিন্তু শাসক হিসেবে সফলতা পাননি কনস্টানটাইন। বুলগার ও আরবদের সাথে পরপর দুটি যুদ্ধে পরাজয় তাকে জনগণের কাছে অপ্রিয় করে তোলে।
নিজের সিংহাসন বাঁচাতে ৭৯২ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় তিনি আইরিনকে সহ-শাসক পদে বহাল করেন। তবে আইরিন এবার পূর্ণরূপে ক্ষমতা দখলের হিসেব কষতে থাকেন। ৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দে নিজ পুত্রের বিরুদ্ধেই তিনি ষড়যন্ত্র করেন। এই ষড়যন্ত্রে অনেককেই পাশে পান আইরিন, যারা কনস্টানটাইনের স্বৈরাচারী মনোভাবে ও কাজকর্মে বেশ বিরক্ত ছিল। বিশেষ করে পুনরায় বিয়ে করে পুত্র না হবার কারণ দেখিয়ে সেই স্ত্রী ও কন্যাদের নির্বাসিত করা ও রানীর সহচরীর সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ানোর ফলে তিনি বিপুল পরিমাণ সমর্থন হারান। এই সুযোগই কাজে লাগান আইরিন। পুত্রকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ষড়যন্ত্র করেন। টের পেয়ে কনস্টানটাইন পালিয়ে যান। কিন্তু তাকে ধরে আনা হয় এবং আইরিনের নির্দেশে চোখ উপড়ে নেয়া হয়। এর কিছু সময় পরেই কনস্টানটাইনের মৃত্যু ঘটে।
কনস্টানটাইনের মৃত্যুর পূর্বেই তাঁর সদ্যোজাত দুই পুত্রসন্তানের মৃত্যু ঘটে। তাই কনস্টানটাইনের মৃত্যুর পর আইরিনের আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রইলো না। এতদিনের আরাধ্য ক্ষমতা এবার তিনি পূর্ণরূপে ভোগ করতে প্রস্তুত হলেন। জনসাধারণের মন পেতে সে বেশকিছু জনকল্যাণমূলক কাজ করেছিলেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও তাঁর করা অপরাধগুলো মানুষ ভুলতে পারছিল না। উপরন্তু নারী হবার কারণে তাকে একচ্ছত্র শাসক হিসেবে অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তিই মেনে নিতে পারছিলেন না।
কোনো নারী এর পূর্বে একচ্ছত্রভাবে রোমের ক্ষমতায় ছিলেন না, এবং রোমান সম্রাটদের মাতা বা কন্যা কখনো তাদের পর ক্ষমতায় যাবেন এমন নিয়ম ছিল না। তাই আইরিন সিংহাসনে থাকলেও রোমের পোপ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সিংহাসন খালি ঘোষণা করেন। ক্ষমতা ধরে রাখতে আইরিন শার্লামেইনের সাথে বিবাহ বন্ধনের প্রচেষ্টা চালান, যিনি তখন রোমের পাশ্চাত্য অংশের শাসক ছিলেন। দুজনেরই উদ্দেশ্য ছিল এই বিয়ের মাধ্যমে নিজ নিজ ক্ষমতা বৃদ্ধি। কিন্তু শেষপর্যন্ত ৮০২ খ্রিস্টাব্দে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইরিনকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে এই প্রচেষ্টা অসফলই থেকে যায়।
কনস্টান্টিনোপোলের উচ্চ আদালত আইরিনকে নির্বাসন দন্ড দেয়। তাকে লেসবোসের এক আশ্রমে নির্বাসিত করা হয়। ৮০৩ খ্রিস্টাব্দ্ব সেখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে।
সম্রাজ্ঞী হিসেবে আইরিন ও তাঁর রাজত্ব কখনোই সফল ছিল না। বরং ক্ষমতা নিয়ে প্রচন্ড অনিশ্চয়তা তাকে নির্দয় ও নিষ্ঠুর এক মানুষে পরিণত করেছিল। তবে তাঁর মূর্তির ছবি পূজাকে বৈধতা দেয়ার কারণে মাঝে মাঝে তাকে গ্রিক সনাতন গীর্জাগুলোতে সাধ্বীরূপে স্মরণ করা হয়। সূত্র: রোয়ার বাংলা।
এসডব্লিউএসএস/০৮২৫
আপনার মতামত জানানঃ