সৌরজগতে বর্তমানে যে বিশাল সূর্য আর বিশাল গ্রহের উপস্থিতিতি আছে তাদের সবগুলোই ছিল মহাজাগতিক ধূলির বিস্তৃত মেঘ। মহাবিশ্বে ভাসমান হাইড্রোজেন গ্যাস, নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদিকে একত্রে বলা হয় মহাজাগতিক ধূলি। কয়েক আলোকবর্ষ ব্যাপী বিস্তৃত এরকম বিশাল ধূলির মেঘ থেকে ঘনীভূত হবার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সৌরজগতের সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ তৈরি হয়েছে।
কিন্তু সৌরজগতের গঠনের সময় কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি ছিল। কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গিয়েছিল। গঠন মুহূর্তে সবকিছু যদি ঠিকঠাক থাকতো তাহলে মঙ্গল গ্রহ ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে আরেকটি গ্রহ তৈরি হতো। এক বা একাধিক কারণে মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে গ্রহটি তৈরি হয়নি। তবে গ্রহ গঠন করতে না পারলেও গ্রহ তৈরির উপাদানগুলো ঠিকই রয়ে গেছে এই দুই গ্রহের কক্ষপথের মাঝখানে। মাঝে থাকা সকল গ্রহাণুকে একত্রে ‘এস্টেরয়েড বেল্ট’ বা ‘গ্রহাণুপুঞ্জ’ নামেও ডাকা হয়।
এরা সবগুলো একত্র হয়ে গ্রহ গঠন করার কথা ছিল কিন্তু পারেনি সম্ভবত বৃহস্পতি গ্রহের দানবীয় আকর্ষণের কারণে। গ্রহ হিসেবে বৃহস্পতি অনেক বড় এবং এ কারণে তার আকর্ষণ শক্তিও বেশি। আকর্ষণ শক্তি বেশি হবার ফলে তা এই ক্ষুদ্র বস্তুগুলোর মাঝে এতটাই প্রভাব ফেলেছে যে, এরা নিজেরা নিজেদের আকর্ষণে একত্র হতে পারেনি। ফলে বড় আকার ধারণ করতে পারেনি। আকারে বড় ও ভারী না হলে গ্রহ গঠন করাও সম্ভব নয়।
সূর্যের পরিবারে যেমন গ্রহাণু বেল্ট আছে, তেমনই শনি গ্রহে উপ-পরিবারেও বলয় বা ‘রিং’ আছে। শনি গ্রহের বলয় আছে বলেই এটি সৌরজগতের সবচেয়ে ব্যতিক্রম ও আকর্ষণীয় গ্রহ। অনেকের মতেই এটি সবচেয়ে সুন্দর গ্রহ। এই গ্রহের বলয় সৃষ্টি হবার কারণ আর গ্রহাণু বেল্ট তৈরি হবার কারণ প্রায় একই। পৃথিবীর যেমন উপগ্রহ চাঁদ আছে, তেমনই শনি গ্রহেরও অনেকগুলো উপগ্রহ আছে। উপগ্রহ তৈরির সময় কোনো একটি উপগ্রহ কোনো কারণে ঠিকভাবে গঠিত হতে পারেনি, তাই ব্যর্থ ক্ষুদ্র বস্তুগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শনির কক্ষপথে। এই বস্তুগুলোই শনির বলয়ের মূল কারণ। এমনিতে শনির মোট উপগ্রহের সংখ্যা ৬২টি, এটি সম্পন্ন হতে পারলে শনির উপগ্রহ হতো ৬৩টি।
গ্রহাণুর এসব টুকরোগুলো সাধারণত ক্ষুদ্র আকৃতির হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে কোনো কোনোটি বড়ও হয়ে থাকে। বড় হিসেবে মোটামুটি চোখে লাগে এবং অন্য কোনো গ্রহের সাথে তুলনা করা যায় এমন ধরনের বস্তুগুলোকে বলে প্লানেটিসেমাল (Planetesimal)। এদের মাঝে সবচেয়ে বড়টার আকৃতি প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার। এর নাম সেরেস। ১ হাজার কিলোমিটার পরিমাণ ব্যাসের কোনো গোলক আকৃতির বস্তুকে গ্রহের বিশালত্বের সাথে তুলনা করা যায়।
কিন্তু এসব দলছুট বস্তুগুলোর বেশিরভাগই গোলক আকৃতির হয় না। এদের আকৃতি হয় অনিয়তাকার। চলার পথে প্রায় সময়ই এক গ্রহাণু আরেক গ্রহাণুর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। মূলত পরিমাণে বেশি তো, তাই সংঘর্ষ ঘটার হারও বেশি থাকে।
এদের মাঝেই কোনো কোনোটি লাইনচ্যুত হয়ে ছুটে আসে অন্য কোনো গ্রহের পানে। অতীতে পৃথিবীর দিকেও ছুটে এসেছে প্রচুর এবং বর্তমানেও আসে অনেক। এদেরকে আমরা দেখেও থাকি। পৃথিবীর একটি চমৎকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে এর বায়ুমণ্ডল। গ্রহাণুগুলো যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে আঘাত করে তখন তার গতি থাকে অত্যন্ত বেশি। বায়ুতে সাধারণত কোনোকিছুর সংঘর্ষ হয় না, কিন্তু গ্রহাণুগুলোর গতি এত বেশি হয় যে এরা বায়ুর পরমাণুর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, এমনকি এই সংঘর্ষে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
রাতের আকাশে যখন এই ঘটনা ঘটে তখন এই ঘটনাকে দেখতে মনে হয় কোনো তারা বুঝি নিজের অবস্থান থেকে বেরিয়ে ছুটে দৌড় দিয়েছে। আসলে ঐ সময়ে কোনো তারা ছুটে বেরিয়ে যায় না, ঐ সময়ে আসলে গ্রহাণু পুড়ে ছাই হয় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে। এই ঘটনাকে সাধারণত উল্কাপাত বলে। ইংরেজিতে আরো কাব্যিকভাবে বলে Shooting Star।
আজ থেকে সাড়ে ৬ কোটি বছর আগের কথা। পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়েছিল আনুমানিক ১০ কিলোমিটার ব্যাসের প্রকাণ্ড এক উল্কাপিণ্ড। আর সেই আঘাতেই পৃথিবী থেকে মুছে গিয়েছিল দৈত্যাকার ডাইনোসরদের অস্তিত্ব। যদিও মতান্তরে ও আধুনিক গবেষণা অনুযায়ী একটি নয়, ওই প্রকাণ্ড আকারের দুটি উল্কাপিণ্ড বা গ্রহাণু সে-সময় খসে পড়েছিল পৃথিবীর ওপর। কতটা ব্যাপক ছিল সেই ধ্বংসলীলা?
আজ প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের দৌলতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে নতুন করে ডিজিটালি রিক্রিয়েট করা হয়েছে প্রকৃতির সেই ধ্বংসলীলাকে। তবে এত ব্যাপকমাত্রায় না-হলেও, এমনই এক প্রকাণ্ড উল্কা খসে পড়ার দৃশ্য সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল আধুনিক সভ্যতারও। তুঙ্গুস্কা ইভেন্ট নামে পরিচিত সেই মহাজাগতিক ঘটনার বীভৎসতা পারমাণবিক বিস্ফোরণের থেকেও কম ছিল না কোনো অংশে।
ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখটা ছিল ১৯০৮ সালের ৩০ জুলাই। সাইবেরিয়ায় (Siberia) স্থানীয় সময় অনুযায়ী ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৭টা বেজে ১৪ মিনিট। কেউ বাজার করতে বেরিয়েছেন পায়ে হেঁটে। কেউ আবার সবে চুমুক দিয়েছেন চায়ের কাপে, খুলেছেন খবরের কাগজ। হঠাৎ-ই আকাশ চিরে খসে পড়ে আগুনের লেলিহান রেখা।
যেন মহাশূন্য থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করছে কোনো ফিনিক্স। তারপরই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। ৫.০ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল গোটা শহর। সেইসঙ্গে কানের পর্দা ফাটানো আওয়াজ। সাইবেরিয়ার চরম শীতেও, বিস্ফোরণের হলকায় পশমের জামা-কাপড় খুলে ফেলেন অনেকেই। এমনকি বিস্ফোরণের দমকে কয়েকশো মাইল দূরে অবস্থিত কানস্ক শহরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রেল চলাচলও।
না, শুধু রাশিয়াতেই নয়। এই বিস্ফোরণের আঁচ পড়েছিল সুদূর ইংল্যান্ডেও। প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লন্ডনের ব্যারোমিটারে আকস্মিক বেড়ে গিয়েছিল বায়ুমণ্ডলীয় চাপের পরিমাণ। অন্যদিকে এই বিস্ফোরণের মূল ঘটনাস্থল, টাঙ্গুস্কা পরিণত হয়েছিল জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে। বিস্ফোরণের ফলে ধরাশায়ী হয়ে পড়েছিল প্রায় ৮ লক্ষ গাছ। গলে গিয়েছিল বছর পর বছর ধরে জমে থাকা বরফ।
পাশাপাশি প্রশান্ত মহাসাগরীয় হাওয়ায় সেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটা অঞ্চলে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চল থেকে নিকটবর্তী জনবসতির দূরত্ব প্রায় ৪০০ কিলোমিটার হলেও, দ্রুত ফাঁকা করে দেওয়া হয় সেইসব গ্রামগুলি।
অবশ্য আজ মহাকাশ থেকে খসে পড়া উল্কা বা গ্রহাণুকে দায়ী করা হলেও, সে-সময় সেই ধারণা ছিল না অধিকাংশ মানুষের মনেই। এমনকি তৎকালীন সময়ে সেভাবে কারণও অনুসন্ধান করা হয়নি এই ঘটনার। বা, বলা ভালো রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সামাজিক পরিমণ্ডল এবং বড়ো প্রাণহানির ঘটনা না-ঘটার কারণেই উপেক্ষা করা হয়েছিল এই ঘটনাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রুশ বিপ্লব— সবমিলিয়ে এই অস্থির সময়ে সম্পূর্ণভাবে ধামাচাপা পড়ে যায় এই বিস্ফোরণের কথা।
এই ঘটনার প্রায় ১৩ বছর পর গবেষণায় নামেন সেন্ট পিটার্সবার্গ মিউজিয়ামের গবেষক এবং উল্কা সংগ্রাহক ভ্লাদিমির কুলিক। বিশেষ গবেষক দল গঠন করে তিনি একাধিকবার অনুসন্ধান চালান টুঙ্গুস্কার (Tunguska) গোটা ধ্বংসক্ষেত্রে। এই দুর্ঘটনার পর দেড় দশক পেরিয়ে গেলেও সেখানে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়নি— এই ঘটনা আশ্চর্য করেছিল কুলিককে।
পাশাপাশি গোটা অঞ্চলে তদন্ত করেও মেলেনি গ্রহাণুর কোনো ধ্বংসাবশেষ, লোহা ও অন্যান্য ধাতুর আকরিক এবং প্রস্তরখণ্ড। পাহাড়ের ওপর থেকে পর্যবেক্ষণ করার সময়ও উল্কা খসে পড়ার দরুন তৈরি হওয়া কোনো বড়ো গর্তের দেখা পাননি তিনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি প্রশ্ন তোলেন তবে সত্যিই কি এই দুর্ঘটনার কারণ কোনো মহাজাগতিক উল্কাপিণ্ড?
সেই শুরু। ১৯৩০-এর দশক থেকে তারপর একে একে উঠে এসেছে একাধিক কনস্পিরেসি থিওরি বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। কেউ দাবি করেছেন, এই ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে ভিনগ্রহীদের আক্রমণ। কেউ আবার ধরে নিয়েছিলেন, নিকোলা টেসলার তৈরি মারণাস্ত্র ‘ডেথ-রে’-র পরীক্ষামূলক ব্যবহারেই এই প্রকাণ্ড বিস্ফোরণ হয়েছিল রাশিয়ার জনহীন প্রান্তরে।
তবে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য তত্ত্ব হিসাবে ধরে নেওয়া হয়, ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী এফ.জে.ডব্লু হুইপেলের প্রস্তাবিত ‘কমেট থিওরি’-কে। হুইপেলের কথায়, এই বিস্ফোরণের জন্য দায়ী ছিল আদতে একটি ধূমকেতু। ধূমকেতু সাধারণত তৈরি হয় ধূলিকণা এবং বরফের মাধ্যমে।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার পর, বাতাসের সঙ্গে ঘর্ষে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছিল এই ধূমকেতুটি। তারপর মাটি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উচ্চতাতেই বিস্ফোরণ হয় তার। ফলে, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল জ্বলন্ত ধূলিকণা। তাতে ভয়াবহ দাবানল ছড়িয়ে পড়লেও মাটির ওপর গর্ত তৈরি হয়নি কোনো।
২০১৩ সালে ইউক্রেনের ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেসের বিজ্ঞানী ভিক্টর কাভাসন্সিয়েস্ট ঘটনাস্থল থেকে বেশ কিছু পাথরের মাইক্রোস্কোপিক নমুনাও খুঁজে পান।
তার বিশ্লেষণ এই তত্ত্বকেও জোরদার করেছিল আরও। তবে এখানেই শেষ নয়। পৃথিবীর পদার্থ এবং মহাকাশ থেকে আগত পরাপদার্থ বা অ্যান্টিম্যাটারের সংঘর্ষে এই বিস্ফোরণ ঘটেছিল বলেও মনে করেন অনেকে।
কেউ মনে করেন, সংস্লিষ্ট অঞ্চলে বিস্ফোরিত হয়েছিল মিথেনের কোনো গোপন খনি। কিন্তু কে আগুন লাগাল সেই খনিতে? সাইবেরিয়ার মতো হিমশীতল অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে আগুন লাগারও যে উপায় নেই কোনো। এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না কোনো।
তবে এই বিতর্কের বাইরে গিয়ে গ্রহাণু বা ধূকমেতু তত্ত্বকেই যদি সত্যি বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে সেই হিসেব অনুযায়ী, পৃথিবীতে খসে পড়া অবাঞ্ছিত আগন্তুকটির আয়তন ছিল প্রায় ৮০ মিটার দীর্ঘ একটি বলের সমান। আর তার জন্যই প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ২৫০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের অঞ্চল বা কয়েক হাজার বর্গকিলোমিটার জমি।
আধুনিক গবেষণা অনুযায়ী, এই বিস্ফোরণের প্রাবল্য ছিল হিরোশিমার পারমাণবিক বিস্ফোরণের থেকেও ১০০০ গুণ বেশি। ফলে, সাইবেরিয়া না-হয়ে অন্য কোনো জনবহুল অঞ্চলে এই বিস্ফোরণ ঘটলে প্রাণ হারাতেন কয়েক লক্ষ মানুষ।
এবার ফিরে যাওয়া যাক ডাইনোসরদের কাহিনিতে। যেখানে এই বিস্ফোরণের জন্য দায়ী মাত্র ৮০ মিটার ব্যাসের একটি গ্রহাণু, সেখানে ডাইনোসরদের যুগে পৃথিবী আঘাত হেনেছিল যে উল্কাটি তার ব্যাস ছিল প্রায় ১০ কিলোমিটার। ফলে, কতটা বীভৎস ছিল সেই বিস্ফোরণ, তা সহজেই আন্দাজ করা যায় এই ঘটনা থেকে।
বর্তমানে বিশেষ মহাকাশযান কিংবা পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রের সাহায্যে উল্কাপিণ্ডের গতিপথ পরিবর্তনের প্রযুক্তি হাতে এসেছে গবেষকদের। যদিও সেই উল্কার ব্যাস যদি ১০ কিলোমিটার হয়, তবে সেক্ষেত্রে মানবসভ্যতার নিস্তার নেই কোনো।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩১০
আপনার মতামত জানানঃ