খাদ্যের বিশ্বায়নের বড় উদাহরণ মরিচ। ক্যাপসিকাম গণের এই বেরি ফ্রুটের গাছটি প্রথম পাওয়া যাওয়ার রেকর্ড আছে বলিভিয়ায়। তবে সেটা বুনো মরিচ। মানুষের খাদ্যতালিকায় তার স্থান ছিল না। চাষ করা হয় এমন মরিচের জাতের সন্ধান প্রথম পাওয়া যায় মেক্সিকোর পূর্ব-মধ্যাংশে, আজ থেকে ছয় হাজার বছর আগে। আজকের দিনে কাঁচা কিংবা পাকা লাল মরিচ ছাড়া দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তেই রান্নার কথা ভাবা যায় না। ঘটনাটি মরিচের বিশ্বায়ন নিশ্চয়ই। মরিচ আজ নতুন নতুন দেশে গিয়ে স্থানীয়দের এমনই আপন হয়ে গিয়েছে যে এটিকে আর ভিনদেশী মসলা মানতে রাজি নয়, এমনকি বিশ্বাস করতেও।
কে টি আচায়া তার ইন্ডিয়ান ফুড: আ হিস্টোরিক্যাল কম্প্যানিয়ন (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ইন্ডিয়া) গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ভারতীয় রন্ধনকলায় মরিচ এমনভাবে জায়গা করে নিয়েছে যে এটি যে স্থানীয় নয় তা বিশ্বাস করা কঠিন।…মরিচ ভারতে আগ্রহভরে গৃহীত হয়েছিল। এটি সবখানে চাষ করা সম্ভব। বাড়ির আঙিনাতেও মরিচ জন্মানো যায়। গোলমরিচের চেয়ে এর জাতও অনেক বেশি। প্রয়োজন কীভাবে ভিনদেশী পণ্যকে নতুন সমাজে গ্রহণযোগ্য করে তোলে তার ক্ল্যাসিক উদাহরণ মরিচ।’
কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো ভারতে আসা পর্তুগিজ চিকিৎসক, নিসর্গবিদ গার্সিয়া দা ওর্টা (১৫০১-৬৮) মরিচের কথা উল্লেখ করেননি। ১৫৯০ সালে রচিত আইন-ই-আকবরিতে আবুল ফজল ৫০টির বেশি খাবারের রেসিপি উদ্ধৃত করেছেন, কিন্তু তার কোনোটাতেই ঝালের জন্য মরিচের নামটি উল্লেখ করেননি। গোলমরিচের জন্য ভারতে যে নাম ছিল চিলি মরিচের জন্য সে নামই গ্রহণ করা হয়—হিন্দিতে কালিমির্চ। মরিচ সম্ভবত বেশ আগেই ভারতে হাজির হয়েছিল। দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ পুরানদারাদাস জীবিত ছিলেন ১৪৮০ থেকে ১৫৬৪ সালের মধ্যে। তিনি মরিচ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমি তোমাকে দেখেছি সবুজ, পাকতে পাকতে তুমি হয়ে গেছ লাল। দেখতে যেমন সুন্দর, খাবারের পাতেও তেমন সুস্বাদু। তবে বেশি ব্যবহার করা হলে খুব ঝাল। সাদামাটা খাবারকে উপভোগ্য করে তোলে। তবে কামড় দিলে কিছু চিন্তা করার ক্ষমতাও থাকে না (ঝালের আধিক্যে)।’
ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে জার্মানি, ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসে ব্যবহূত মরিচের বেশির ভাগই যেত ভারত থেকে। ভারত এখনো দুনিয়ার অন্যতম মরিচ উৎপাদন ও ভোগকারী। এমনকি অনেক ইউরোপীয়র মধ্যে এমন ধারণা ছিল যে মরিচের উদ্ভব ভারতেই। জার্মান উদ্ভিদবিদ লেয়নহার্ট ফাস ১৫৪২ সালে প্রকাশিত তার এক গ্রন্থে কালিকট পিপার ও ইন্ডিয়ান পিপারের নাম উল্লেখ করেন।
দক্ষিণ ভারতে মরিচের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। গুনটুর শহরে মরিচের আচার তৈরি হয় মরিচের তেল দিয়ে! গুনটুরে মরিচের নিজস্ব প্রজাতিও আছে।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে স্প্যানিশ অভিযাত্রীদের জাহাজে মরিচ আমেরিকা থেকে ইউরোপের মাটিতে হাজির হয়। লিসবনের বন্দর থেকে মরিচ ইউরোপ হয়ে অটোমান সাম্রাজ্যে পৌঁছে যায়। এশিয়া, আফ্রিকায়ও দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। স্প্যানিশ গনজালো ফার্নান্দেজের ১৫১৩ সালে লিখিত বিবরণী থেকে জানা যায়, স্পেন ও ইতালিতে রান্নায় মরিচ ব্যবহার ছিল নিয়মিত। তিনি আরো উল্লেখ করেন, মাছ-মাংস রান্নায় মরিচ, গোলমরিচের চেয়ে ভালো জিনিস। মরিচ বিনা বাধায় এশিয়া জয় করলেও ইউরোপে একটি ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বাধার মুখে পড়েছিল। উত্তর ইউরোপে প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার মরিচকে গ্রহণে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সাগর পাড়ি দিয়ে যারা আমেরিকা থেকে মরিচ নিয়ে এসেছিলেন সেসব অভিযাত্রীরা ছিলেন মূলত ক্যাথলিক। অন্যদিকে এ সময় ক্যাথলিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রোটেস্ট্যান্টদের প্রতিরোধ চলছিল। তাই উনিশ শতকের শেষ ভাগ অবধি আল্পস অঞ্চলে মরিচের গ্রহণযোগ্যতা ছিল কম।
পর্তুগিজরা মরিচ খুঁজে বের করলেও তারা নিজেরা মরিচকে আপন করে নেয়নি সেই প্রাথমিক কালে। অন্যদিকে স্প্যানিয়ার্ডরা চিলিকে দ্রুতই নিজেদের খাদ্যতালিকায় যুক্ত করে নেয়। পর্তুগিজরা মরিচ ভারতের বন্দরে নিয়ে এসেছিল। এরপর ভারতীয়রা তা গ্রহণও করে। কিন্তু ভারতের পর্তুগিজরা মরিচকে আপন করে নেয়নি। এমনকি এখনো বলা হয় পর্তুগিজদের মধ্যে মরিচের ব্যবহার কম।
পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের অভিযাত্রার সময় মরিচ পশ্চিম আফ্রিকায় নিয়ে গিয়েছিল, সঙ্গে আরো ছিল তাদের পিরি পিরি সস। মোজাম্বিকের মানুষ এই সস এত পছন্দ করেছিল যে এটা তাদের জাতীয় খাদ্যের মতো হয়ে যায়। নামিবিয়া, অ্যাঙ্গোলা, দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষও মরিচের ঝালে মাত হয়ে যায়। এরপর পর্তুগিজরা বাহিয়া ও ব্রাজিলে থাকা আফ্রিকান দাসদের মধ্যে মরিচ নিয়ে যায়। বলা হয় আফ্রিকান খাবারে মরিচের ব্যবহার নিয়ে উল্লেখ করতে আস্ত একটা বই লিখতে হবে। এ থেকে বোঝা যায়, ঝাল আফ্রিকানদের বেশ পছন্দ। আফ্রিকার সবক’টি দেশই এখন বাণিজ্যিকভাবে মরিচ উৎপাদন করে।
ক্যাপসেইসিন মরিচের অন্যতম উপাদান। মরিচ পেটে গেলে ক্যাপসেইসিনের কারণে মস্তিষ্কে ব্যথার বার্তা প্রেরিত হয় এবং আফিমসদৃশ এন্ডরফিন নিঃসরিত হয়। অনেকেই এতে নিজের অজান্তেই আসক্ত হয়ে পড়েন। এবং সারা জীবন এই ঝালের রোমাঞ্চ থেকে বের হতে পারেন না। এ রকম আসক্তদের জন্য ইংরেজি ভাষায় একটি শব্দ আছে—চিলিহেড। আমেরিকার ইনকা, মায়া কিংবা পাপাগো ইন্ডিয়ানদের কাছে মরিচ ছিল পবিত্র। অ্যাজটেকদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় মরিচ এতটা জরুরি ছিল যে মরিচ পাতে না থাকলে তা ছিল তাদের কাছে অভুক্ত থাকার মতো।
মরিচের রঙও এর জনপ্রিয়তায় ভূমিকা রেখেছে। কাঁচা অবস্থায় ঝকমকে সবুজ আর পাকলে টকটকে লাল। এমনকি রান্নার পরেও এর রং বদলায় না। মরিচের আগে ইউরোপে এ রকম উজ্জ্বল লাল রঙের কোনো সবজি ছিল না। ছিল বিট মূল, যা কিছুটা বেগুনি, কিছুটা লাল। কিছু লাল ফল ছিল, মরিচও তা, কিন্তু সেগুলো মরিচের মতো সবজি হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। প্রাচীনকাল থেকেই ইউরোপীয়রা লাল রঙকে আগুন, বিপদ, ক্রোধ, রক্তের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছেন। মরিচও ঝাল তপ্ত স্বাদের, লাল রঙের। এমনও মত ছিল যে রাগী মানুষদের মরিচ খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত।
মরিচ খাওয়ার সঙ্গে পৌরুষ দেখানোর সম্পর্কও আছে অনেককাল ধরে। অ্যাজটেক শাসক মন্টেজুমা উৎসর্গ করা মানুষের মাংস খেতেন মরিচের সস লাগিয়ে। মরিচ খাওয়ার প্রতিযোগিতা পৌরুষ প্রদর্শনের সুযোগ হিসেবে আধুনিক কালেও জনপ্রিয়। জনপ্রিয় আমেরিকার সিটকম দ্য সিম্পসনসে হোমারকে দেখা গিয়েছিল এমন এক মরিচ খাওয়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। হোমার এক বাটি মরিচ খেয়ে নিয়েছিলেন।
মরিচের জন্ম যে মেসো ও দক্ষিণ আমেরিকায় সেখানে মরিচকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। আমেরিকার আদি বাসিন্দাদের লোকজ ওষুধবিদ্যায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল মরিচ। এরপর ইউরোপের চিকিৎসকরা মরিচের ঔষধি গুণাবলিকে নিয়ে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে উদ্ভিদবিদ ও চিকিৎসকরা স্মৃতিলোপের ওষুধ হিসেবে মরিচ ব্যবহার করতেন। উনিশ শতকে নানা ধরনের প্রদাহের বিরুদ্ধে মরিচ ব্যবহূত হতো। চীনা ওষুধশাস্ত্রে মরিচ ছিল অ্যান্টিসেপটিক। ভারতীয় আয়ুর্বেদেও আছে মরিচের ব্যবহার। সূত্র: সিল্করুট।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ