সুইডেনে মুসলিমদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের কপি পোড়ানোর এক ঘটনার প্রতিবাদে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের সুইডিশ দূতাবাসে এক দল লোকের জোর করে ঢুকে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। বুধবার স্টকহোম শহরের কেন্দ্রীয় মসজিদের বাইরে কোরআনের একটি কপিতে আগুন ধরিয়ে দেয় এক ব্যক্তি।
তার নাম সালওয়ান মোমিকা এবং সে সুইডেনে বসবাসরত একজন ইরাকি বলে জানানো হয়েছে। তুরস্ক, ইরাক, ইরান, মিশর ও সৌদি আরব সহ বেশ কয়েকটি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এ ঘটনার তীব্র নিন্দা করে।
ইরাকের একজন ক্ষমতাধর ধর্মীয় নেতা মোকতাদা আল-সদর এর প্রতিবাদ জানানোর ডাক দিলে বৃহস্পতিবার রাজধানী বাগদাদে সুইডিশ দূতাবাসের সামনে একদল লোক জড়ো হয়।
সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে বেশ কিছু লোককে ভবনটির প্রাঙ্গণে হাঁটতে দেখা যায়। ঘটনাস্থলে থাকা এএফপির একজন ফটোসাংবাদিক বলেছেন, কিছু লোক দূতাবাস ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং প্রায় ১৫ মিনিট সেখানে অবস্থান করে। পরে স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনী আসার পর তারা সেখান থেকে চলে যায়।
সুইডেনের কর্তৃপক্ষ বলছে, মোমিকাকে দেশের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংক্রান্ত আইনের আওতায় মসজিদের বাইরে প্রতিবাদ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। তবে কোরআন পোড়ানোর ঘটনা ঘটার পর পুলিশ বলছে যে তারা এখন ঘৃণা উস্কে দেবার দায়ে ঘটনাটির তদন্ত করছে।
তুরস্ক এ ঘটনার তীব্র নিন্দা করে বলেছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে এ ধরনের ইসলাম-বিরোধী কর্মকান্ড অগ্রহণযোগ্য। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রেচেপ তায়েপ এরদোয়ান বলেছেন, “উদ্ধত পশ্চিমাদের আমরা একসময় শিক্ষা দেবো যে মুসলিমদের অপমান করা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নয়।”
মরক্কো ও জর্ডান এ ঘটনার প্রতিবাদে স্টকহোম থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতদের দেশে ফিরে আসতে বলেছে। মরক্কোর রাবাতে সুইডিশ রাষ্ট্রদূতকে তলবও করা হয়। মিশর বলেছে, যখন মুসলিমরা ঈদুল আজহা পালন করছে তখন এই লজ্জাজনক ঘটনা বিশেষভাবে উস্কানিমূলক।
সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী উল্ফ ক্রিস্টারসন বলেছেন এ ঘটনা “আইনগতভাবে বৈধ হলেও অনুচিত” ছিল। সুইডেনে কোরআন পোড়ানোর পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে এর আগে দাঙ্গা হয়েছে।
নেটো সদস্য তুরস্ক এর আগে সুইডেনকে এ জোটের সদস্যপদ দেয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করেনি এবং এর একটি কারণ হিসেবে এধরনের ঘটনার কথা উল্রেখ করেছে।
এর আগে গত ২১ জানুয়ারি সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে তুরস্কের দূতাবাসের সামনে পবিত্র কুরআন পোড়ানো মতো ঘৃণ্য ঘটনা ঘটে। মূলত ২০২২ সালের জুনে সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দিতে তুরস্কের সাথে চুক্তি করে ফিনল্যান্ড-সুইডেন। ওই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, কুর্দি সন্ত্রাসীদের কোনো প্রশয় দিতে পারবে না এই দুটি দেশ। একই সাথে ফিনল্যান্ড-সুইডেনে বসবাসরত পলাতক কুর্দি সন্ত্রাসীদের তুরস্কের হাতে তুলে দিতে হবে। তবে সুইডেন সেসব শর্ত ভঙ্গ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সামরিক জোট ন্যাটোতে তুরস্ক যোগ দেয় ১৯৫২ সালে।
নিয়মানুযায়ী মার্কিন নেতৃত্বাধীন এই জোটে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের সম্মতির প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে এই জোটে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ রয়েছে তুরস্কের। স্টকহোমে তুরস্কের দূতাবাসের সামনে কুরআন পোড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে সুইডেনের ন্যাটোভুক্তি অনুমোদন করবে না বলে তুরস্ক ইঙ্গিত দিয়েছে (প্রাগুক্ত)।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এক ভিডিওতে রাসমুস বলেন, ‘ইসলাম ও মুসলিমরা হচ্ছে শত্রু। এই পৃথিবীতে যদি একজন মুসলিমও না থাকে তা হলে খুব ভালো হবে, তা হলে আমরা আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাব।’
ডেনমার্কে বর্ণবাদী ভাষণের কারণে ২০১৯ সালে ১৪ দিনের জেল হয় পালুদানের। এর এক বছর পর ১৪ ধরনের বর্ণবাদী, মানহানি ও বিপজ্জনক ড্রাইভিংয়ের কারণে আরো জেল হয় পালুদানের। সুইডেনের স্ট্রাম কুর্স কট্টরপন্থী দল ডেনমার্কের ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে একটি আসনেও জয় পায়নি। বর্তমানে পালুদান আগামী ২০২৩ সালের জুনে নির্বাচনে ফের লড়বেন বলে পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু তার প্রার্থিতার জন্য যথেষ্ট স্বাক্ষর নেই।
এটি সুইডেনের মতো সার্বভৌম দেশের নাগরিক আইন ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের পরিপন্থী। ইচ্ছাকৃতভাবে মুসলমানদের অনুভ‚তিতে ক্ষুব্ধ করার মতলবে কতিপয় চরমপন্থী পবিত্র কুরআনে অগ্নিসংযোগ করে। এটিকে উসকানিমূলক অপরাধ বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
ধর্ম ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে চরমপন্থা ও ঘৃণাকে পরাস্ত করার বৈশ্বিক প্রচেষ্টার বিপরীতে এ হামলাকে শান্তিপ্রিয় মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। এ ধরনের বিদ্বেষপ্রসূত ঘটনা মোকাবেলা করার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টাকে জোরদার করার কথা বলছেন বোদ্ধামহল।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষক ড. হামদান আল-শেহরি বলেন, ‘সন্ত্রাসী ও অপরাধী যারা অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতিকে সম্মান করে না এবং যারা মতবিরোধকে উসকে দিতে চায় এবং বিশ্বকে ধর্মীয় যুদ্ধে টেনে আনতে চায়, তাদের কর্মতৎপরতার পরিণতি যাই হোক, কোনোক্রমে ঘৃণা প্রকাশের অবারিত সুযোগ দেয়া উচিত নয়।
অতীতে মুসলমানদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য প্রথাগত বা মিডিয়ার মাধ্যমে একটি ভয়ঙ্কর প্রচারণা দেখেছি; মুসলমানরা বিশ্বের জনসংখ্যার ২০০ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। এসব প্রচারাভিযান প্রকাশ্যে প্রতিক‚লভাবে পরিচালিত হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে চালিয়ে দেয়া হয়।’ মুসলমানরা সবসময় সংস্কৃতি ও ধর্মকে সম্মান করতে আগ্রহী (আরব নিউজ, জেদ্দা, ১৯ এপ্রিল, ২০২২)।
পবিত্র কুরআন পোড়ানোর ঘটনায় বিশ্বের দেশে দেশে নিন্দার ঝড় উঠেছে। এরই মধ্যে ন্যক্কারজনক এ ঘটনার প্রতিবাদে সরব হয়েছে তুরস্ক, সৌদি আরব, জর্দান, আরব আমিরাত, সোমালিয়া ও কুয়েত। নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তানও। মুসলিমবিদ্বেষী এ নেতা কুরআন পোড়ানোর পরপরই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিবৃতি দেয় তুরস্ক। তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘আমরা আমাদের পবিত্র গ্রন্থের ওপর জঘন্য হামলায় তীব্র ভাষায় নিন্দা জানাই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে এমন ইসলামবিরোধী কাজের অনুমতি দেয়া কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এটি মুসলিমদের নিশানা এবং আমাদের পবিত্র মূল্যবোধের অবমাননা করে।’
কুরআন পোড়ানোর প্রতিবাদে তুরস্ক সুইডিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর একটি আসন্ন সফর বাতিল করেছে। ওই সফরে সুইডেনের ন্যাটো সদস্যপদ পাওয়ার বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। পুরনো সব সদস্যের সমর্থন ছাড়া এ পশ্চিমা সামরিক জোটে কেউ নতুন সদস্য হতে পারে না। তাই সুইডেনকে ন্যাটোর সদস্য হতে হলে অবশ্যই তুরস্কের সম্মতি আদায় করতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১১০০
আপনার মতামত জানানঃ